আজকাল ওয়েবডেস্ক: 'নদীর পাড়ে বাস ভাবনা বারো মাস'। মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা এবং সামশেরগঞ্জ ব্লকে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের জন্য এই প্রবাদ যেন চিরসত্য হয়ে গিয়েছিল। তবে এবার তা বদলাতে চলেছে।
নদীতে জল বাড়লে প্রতিবছরই মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অংশ ভাঙনের কবলে পরে। কেন্দ্র সরকার মুর্শিদাবাদের নদী ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কোনও অর্থ বরাদ্দ না করায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গত কয়েক বছরে সামশেরগঞ্জের ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। তা সত্ত্বেও ভাঙন আটকানো সম্ভব হচ্ছে না।
তবে এবার আর বাড়তি কোনও অর্থ বরাদ্দ না করেই মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জের পারলালপুর-অনন্তপুর থেকে ধুলিয়ান পর্যন্ত গঙ্গা নদীর 'বাৎসরিক ভাঙন' প্রতিরোধের জন্য একটি অভিনব পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্যের সেচ দপ্তর। তাদের অনুমান, এই পরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে সামশেরগঞ্জের ভাঙন কবলিত এলাকায় দীর্ঘস্থায়ীভাবে নদী ভাঙন বন্ধ তো হবেই এবং সেইসঙ্গে ওই এলাকাগুলিতে নতুন চরের জমি তৈরি হবে।
এর পাশাপাশি এই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর রাজ্য সরকারের কোষাগারে ঢুকবে কয়েকশো কোটি টাকা।
রাজ্য সেচ দপ্তরের এক শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ার জানান, 'সামশেরগঞ্জ ব্লকে গঙ্গা নদীর ভাঙন মোকাবিলা করার জন্য আমরা পারলালপুর থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার একটি 'পাইলট চ্যানেল' খনন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এই কাজ শেষ হলে গঙ্গা নদীতে জল প্রবাহের ক্ষমতা বাড়বে এবং নদীর বর্তমান 'গতিপথ' কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।'
আরও পড়ুন: প্লাস্টিকের বোতলের মদে দিতে হবে বাড়তি মাশুল, এই রাজ্যে চালু নতুন নিয়ম
প্রসঙ্গত, মুর্শিদাবাদ জেলায় ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরি হওয়ার আগে থেকেই নদী ভাঙনের সমস্যা থাকলেও ব্যারেজ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ -ফরাক্কা -লালগোলা -ভগবানগোলা -জলঙ্গি-সহ বেশ কিছু এলাকায় গঙ্গা নদীর ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। ২০২১ সালের লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রকের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গঙ্গা এবং পদ্মা নদীর ভাঙনে মুর্শিদাবাদ জেলায় ফরাক্কা , সামশেরগঞ্জ-,সুতি ১ এবং ২, রঘুনাথগঞ্জ -২, লালগোলা, ভগবানগোলা ১ এবং ২ রানীনগর-২ এবং জলঙ্গি ব্লক সহ ধুলিয়ান পুরসভা এলাকায় মোট ৭৩০ হেক্টর জমি জলে তলিয়ে গিয়েছে। গত ছয় বছরে তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ আরও প্রায় ৪০০ হেক্টর বেড়েছে বলে সেচ দপ্তর সূত্রের খবর।
মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ ব্লকে ভাঙন প্রতিরোধের অভিনব পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সেচ দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, এই কাজের জন্য রাজ্য সরকার যে টেন্ডার ডেকেছে তাতে সরকারের কোনও টাকা খরচ হবে না। বরং সরকারের কোষাগারে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা পড়তে চলেছে। তিনি বলেন, বেনিয়াগ্রাম, নয়নসুখ, অর্জুনপুর, মহেশপুর, ধুলিয়ান পুরসভা এলাকা,পারলালপুর, হোসেনপুর, তিনপাকুরিয়া, প্রতাপগঞ্জ ,নিমতিতা-সহ একাধিক জায়গায় নদী বক্ষে প্রচুর নতুন চর জেগে উঠেছে। এর ফলে নদীর মূল প্রবাহ বিভিন্ন জায়গায় বেঁকে যাচ্ছে এবং গঙ্গা নদীর জল গিয়ে সামশেরগঞ্জের নিমতিতা- প্রতাপগঞ্জ -চাচন্ড পঞ্চায়েত এবং ধুলিয়ান পুরসভা এলাকায় প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা মারছে এবং পাড়ে ভাঙন দেখা দিচ্ছে।

ওই আধিকারিক জানান, নতুন যে 'পাইলট চ্যানেল'টি করা হবে তা করতে গিয়ে নদীর চর থেকে প্রায় ৫৪ লক্ষ কিউবিক মিটার শুকনো মাটি তুলে ফেলা হবে। এর ফলে গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ এঁকেবেঁকে প্রবাহিত না হয়ে অনেকটা সোজা পথে যাবে এবং সামশেরগঞ্জ ব্লকে নদী ভাঙনের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
ওই আধিকারিক বলেন ,চ্যানেলটি খোঁড়ার জন্য যে বিপুল পরিমাণ মাটি উত্তোলন করা হবে তা মূলত নিচু জায়গা ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হবে এবং এই কাজ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা যে মুনাফা অর্জন করবে তার থেকে রাজ্য সরকারকে রয়্যালটি দেবে। যন্ত্র ব্যবহার করে চ্যানেল খোঁড়া থেকে শুরু করে মাটি তোলা, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সম্পূর্ণ নিজের খরচে করবে।
সেচ দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে , গঙ্গা নদীতে জল কিছুটা কমার পর এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। 'পাইলট চ্যানেল' কাটার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেখানে যে বাধা থাকবে পরবর্তী বর্ষায় নদীর জল সমস্ত কিছু ধুয়ে নিয়ে চলে যাবে। তাঁরা জানান, ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ নদীর 'ডাউন স্ট্রিমে' ৬.৯ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। তাই সেচ দপ্তর ওই এলাকার পর থেকে নিজেদের কাজ শুরু করবে।
ফরাক্কার তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন,' ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরির হওয়ার পর গঙ্গা নদীর ভাঙনে হাজার হাজার বাড়ি-ঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জলে তলিয়ে গেলেও কেন্দ্র সরকার সবকিছু দেখেও উদাসীন। বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা নদীর জল বন্টন চুক্তির সময়ে তারা রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। আমার জন্মের পর থেকে কোনওদিন ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষকে গঙ্গা নদীতে 'ড্রেজিং' করতে দেখিনি।'
তিনি বলেন,' রাজ্য সেচ দপ্তরের এই প্রকল্পে সামশেরগঞ্জ এবং ফরাক্কায় গঙ্গা নদী ভাঙন প্রতিরোধে একটি স্থায়ী সমাধানের আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। গঙ্গানদী বক্ষে যে সমস্ত চর জেগে উঠেছে সেগুলো কেটে পরিষ্কার করলে নদীর জল ধারণ ক্ষমতা বাড়বে এবং ওই মাটি বিক্রি করে রাজ্য সরকারের কোষাগারে রয়্যালটির বিপুল টাকা ঢুকবে। '
