আজকাল ওয়েবডেস্ক: ধানমুন্ডিতে অবস্থিত প্রখ্যাত বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট এবং তার শিক্ষা শাখা নালন্দার কার্যালয়ে ভয়াবহ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর সংস্কৃতি দিয়েই প্রতিবাদে নামলেন প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র, শিক্ষক ও প্রাক্তনীরা। পুড়ে যাওয়া ও লণ্ডভণ্ড ভবনের সামনেই গান গেয়ে, রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা জানান ভয় নয়, সংস্কৃতিই তাদের অস্ত্র।
শুক্রবার ভোররাতে ধানমুন্ডির সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত ছায়ানটের সাততলা ভবনে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তারা ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে দেয়, ভেতরে ঢুকে বাদ্যযন্ত্র, বইপত্র ও আসবাবপত্র ধ্বংস করে এবং একাধিক স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলায় সিসিটিভি ক্যামেরা, সাউন্ড সিস্টেম, শিল্পকর্ম ও শিক্ষাসামগ্রী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক কক্ষ সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, 'ইনকিলাব' মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান বিক্ষোভের রেশ ধরেই ভোররাতে এই হামলা হয়। ঘটনার সময় ভবনের আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
শুক্রবার সকাল হতে না হতেই ছায়ানটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রাক্তনীরা একে একে ঘটনাস্থলে জড়ো হতে থাকেন। তারা প্রথমে পোড়া ভবন ও ধ্বংসস্তূপ ঘুরে দেখেন। এরপর ভবনের সামনে সাত মসজিদ রোডে দাঁড়িয়ে সম্মিলিতভাবে গান শুরু করেন। কালো ধোঁয়ার দাগ আর ভাঙা দেওয়ালের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাওয়া হতে থাকে, যেন হিংসার ভাষার জবাবে সংস্কৃতির শান্ত অথচ দৃঢ় উচ্চারণ।
গানে গানে তারা ভয় ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানান। 'সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’- এই গানের কথাগুলো বারবার উচ্চারিত হয়, যা উপস্থিত মানুষদের সাহস ও প্রত্যয়ের বার্তা দেয়। অংশগ্রহণকারীরা বলেন, এই আয়োজন কোনও তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং সচেতনভাবেই তারা সংঘাত নয়, সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছেন।
ছায়ানট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই হামলার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, ছায়ানট একটি স্বেচ্ছাসেবী ও স্বনির্ভর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এটি কোনো সরকার, বিদেশি সংস্থা বা কর্পোরেট অনুদানের ওপর নির্ভরশীল নয়। ফলে এই ক্ষয়ক্ষতি ছায়ানটকেই বহন করতে হবে।
ছায়ানটের ভাষায়, “সঙ্গীত ও শিল্পের সাধারণ শিক্ষায় নিয়োজিত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এ ধরনের বর্বর হামলা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ছায়ানটের কাজের ক্ষেত্র রাজনীতি নয়, বরং সঙ্গীত-সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করা।
ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সরকারও। সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক বিবৃতিতে এই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকে “সুস্পষ্ট ফৌজদারি অপরাধ” বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের হিংসা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী এবং দেশের চলমান গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সঙ্গে অসংগত। দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়ে তিনি হংসার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি সংস্কৃতি ও পরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক হয়ে উঠেছে। অতীতেও ছায়ানট হিংসার লক্ষ্য হয়েছে- ২০০১ সালে নববর্ষের অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলায় বহু মানুষ নিহত হন।
সর্বশেষ হামলার পরও ছায়ানটের সদস্যরা জানিয়ে দিয়েছেন, তারা ভয় পেয়ে পিছু হটবেন না। তাদের ভাষায়, “আমরা জানি কীভাবে জবাব দিতে হয়- গান দিয়ে, সংস্কৃতি দিয়ে, মানুষের মন জাগিয়ে।” ধ্বংসস্তূপের মাঝেও সেই কণ্ঠস্বরই যেন জানান দিচ্ছিল, ছায়ানটকে পোড়ানো যায়, কিন্তু তার চেতনা নয়।
