আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১০০ বছরের বেশি বয়সে মারা গেল ভারতের তথা এশিয়ার অন্যতম প্রবীণ হাতি ‘ভাত্সলা’। মঙ্গলবার পন্না টাইগার রিজার্ভে তাঁর মৃত্যুতে শেষ হল এক যুগের। বনদপ্তর ও টাইগার রিজার্ভের কর্মীরা ভাত্সলার অন্তিম সংস্কার সম্পন্ন করেন রাজকীয় মর্যাদায়। ‘দাদি’ নামেই সকলের পরিচিত এই স্ত্রী হাতিটি একসময় কেরল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল নর্মদাপুরমে। সেখান থেকে শেষপর্যন্ত স্থায়ীভাবে বাস শুরু করে পন্না টাইগার রিজার্ভে। দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে সে শুধু একটি হাতি'ই ছিল না, রিজার্ভের এক অন্যতম অমূল্য সদস্য হয়ে উঠেছিল। বনরক্ষা অভিযানে তাঁর অসামান্য ভূমিকার জন্য তাঁকে ভালোবেসে সবাই ডাকত ‘নীরব অভিভাবক’ বলে।
ভাত্সলা অনেকটা সময় বন পাহারার কাজে নিয়োজিত ছিল। পুড়িয়ে দেওয়া গাছ, চোরাশিকারিদের গতিবিধি, কিংবা গভীর জঙ্গলের বিপদ—সব কিছু সামাল দিতে তাঁর অসামান্য প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা কাজে আসত। বিশেষ করে ২০০৯ সালে পন্না টাইগার রিজার্ভে বাঘ পুনঃস্থাপনের সময় বনকর্মীদের সঙ্গে মিলিতভাবে বনের গভীরে পর্যবেক্ষণের কাজেও অংশ নিয়েছিল সে। অরণ্যের পথচেনা এই বিশাল হাতিটি, একাধিক অভিযানকে সাফল্যের পথে নিয়ে গিয়েছে। রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের বিবৃতি অনুযায়ী, ভাত্সলা ছিল দলের নেত্রী। অন্য স্ত্রী হাতিরা যখন শাবকের জন্ম দিত, তখন ভাত্সলাই হত সেই দলের 'ঠাকুমা', অভিভাবকসুলভ স্নেহে আগলে রাখত ছোটদের। এই মাতৃস্নেহ ও প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞতার জন্য তরুণ হাতিদের মধ্যেও সে ছিল গভীর শ্রদ্ধেয়।
তবে বয়সের ভারে ভাত্সলার শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল। চোখে আলো ছিল না, সামনের পায়ের নখে সংক্রমণ হয়েছিল। শেষদিকে হাঁটতে কষ্ট হতো তাঁর। হিনাউটা রেঞ্জের খাইরাইয়া ড্রেনের ধারে বসে পড়েছিল চিরতরে, আর উঠতে পারেননি। বনদপ্তর বহু চেষ্টা করেও তাঁকে আর দাঁড় করাতে পারেনি। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব এক্স-এ লেখেন, “আজ ‘ভাত্সলা’র শতাব্দী-ব্যাপী সঙ্গ থেমে গেল। সে শুধু হাতি নয়, ছিল আমাদের অরণ্যের নীরব রক্ষক, এক সজীব ইতিহাস।” তিনি আরও জানান, “ভাত্সলা শুধু জঙ্গলের অংশ ছিল না, সে আমাদের আবেগের প্রতীক। তাঁর চোখে ছিল অভিজ্ঞতার সাগর, তাঁর উপস্থিতিতে ছিল অরণ্যের উষ্ণতা।” ভাত্সলার মৃত্যুতে শুধু পন্নার বনভূমিই নয়, কেঁদে উঠেছে গোটা দেশ। এক জীবন্ত কিংবদন্তি বিদায় নিল, রেখে গেলে এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত—সহিষ্ণুতা, কর্তব্য ও নিরব সেবার।
ভাত্সলা শুধু পন্না টাইগার রিজার্ভের এক প্রবীণ সদস্যই ছিলে না, ছিল এক অভিভাবকতুল্য সঙ্গী—নীরব, সহানুভূতিশীল এবং অবিশ্বাস্যরকম বন্ধুত্বপূর্ণ। তাঁর দীর্ঘ জীবনে সে শুধু বনরক্ষীদের বিশ্বস্ত সহচর ছিল না, ছিল বহু পশু-পাখি ও অন্য হাতিদের কাছেও এক শান্ত অথচ দৃঢ় আশ্রয়। রিজার্ভের বহু পুরনো কর্মী আজও স্মরণ করেন, কীভাবে ভাত্সলা নতুন নিয়োগ পাওয়া বনকর্মীদের সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে তুলত। প্রথম কয়েকদিন সে নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করত, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার শুঁড় দিয়ে হালকা ছোঁয়া দিত, যেন এক নিঃশব্দ অনুমোদন। একবার এই বিশ্বাস গড়ে উঠলে, সে ওই কর্মীকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত পাহারার কাজে।
ভাত্সলার সবচেয়ে স্মরণীয় দিক ছিল তাঁর তরুণ হাতিদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ। যেসব হাতি নতুন করে রিজার্ভে যোগ দিত, তাদের মাঝে কখনও দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ভাত্সলাই হস্তক্ষেপ করত। সে নিজের শুঁড় তুলে শান্তভাবে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্ব থামিয়ে দিত, যেন প্রকৃত একজন অভিজ্ঞ প্রবীণ। অনেক সময় পর্যটকরা বিস্ময়ে দেখেছেন, কীভাবে শাবকদের সঙ্গে সে খেলত—মাটি থেকে শুঁড়ে তুলে নিয়ে জল ছিটিয়ে দিত বা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে শাবককে খুঁজতে খেলায় মাতত। এমনকি বনদপ্তরের কুকুর কিংবা ঘোড়ার সঙ্গেও ভাত্সলার সম্পর্ক ছিল এক বিরল বন্ধুত্বের। একবার এক ছোট কুকুর, ‘কালু’, প্রায় রোজই এসে ভাত্সলার পায়ের কাছে বসত। আশ্চর্যের বিষয়, বিশাল দেহী এই হাতিটি তার আশেপাশে একবারও হুঁশিয়ারি দেয়নি, বরং পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কালুকে সে প্রায় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দিত। যেন এই দুই প্রাণীর মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক অনুচ্চারিত বন্ধনের ভাষা।
বনবিভাগের একজন প্রবীণ আধিকারিক বলেন, “ভাত্সলার মতো বন্ধুবান্ধব প্রকৃত প্রাণী আমরা খুব কমই দেখেছি। তার মধ্যে একধরনের মানসিক স্থিরতা ছিল, যা মানুষকেও শান্ত করত। যাঁরা ওর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা জানেন—ও কেবল হাতি নয়, এক উদার হৃদয়ের প্রতীক।” এইরকম এক নিঃশব্দ অথচ স্পর্শকারী বন্ধুত্বপূর্ণ চরিত্রের হাতির মৃত্যু শুধু প্রাকৃতিক শূন্যতাই নয়, এক মানবিক ব্যথাও রেখে গেল বনপ্রেমী ও রিজার্ভ কর্মীদের হৃদয়ে।
