আজকাল ওয়েবডেস্ক: লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে (LSE) সদ্য সমাপ্ত ‘LSE ফেস্টিভাল: ভিশনস ফর দ্য ফিউচার’ অনুষ্ঠানে দুই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও দারন আসেমগ্লু দু'টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলেন, যা ভবিষ্যতের অর্থনীতি ও গণতন্ত্র চর্চার পথে নতুন আলো ফেলেছে। ৯১ বছর বয়সেও স্বচ্ছ চিন্তাশক্তিতে অমর্ত্য সেন তাঁর বক্তব্যে জোর দিলেন ‘নিশ্চয়তার’ বদলে ‘সন্দেহ’ এবং কৌতূহলকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিস্তৃত করার ওপর, যাতে অর্থনীতি চর্চা একবিংশ শতাব্দীতে আরও আন্তঃবিভাগীয় হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, আজকের তথ্যে ভরা পৃথিবীতে কেবল সংখ্যাগত বিশ্লেষণ যথেষ্ট নয়, বরং সমাজ, রাজনীতি, ভূগোল ও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে অর্থনীতিকে দেখতে হবে। অন্যদিকে, আসেমগ্লু তাঁর বক্তব্যে লিবারাল গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটকে ব্যাখ্যা করলেন কঠোর ভাষায়। তাঁর মতে, গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ — কাজ, মর্যাদা ও অংশগ্রহণ — আজ ধসে পড়ছে প্রযুক্তি ও শ্রেণি বিভাজনের চাপের মধ্যে।

তথ্যের যুগে সন্দেহ ও বহুমাত্রিক চিন্তার প্রয়োজন
অমর্ত্য সেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত হবে ছাত্রদের এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে তারা সন্দেহ করতে, প্রশ্ন করতে শেখে। তিনি বলেন, ‘‘তথ্য যত বাড়ছে, ততই আমাদের চিন্তা একমুখী ও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মতো প্রযুক্তি আমাদের ভাবনাকে নির্ধারিত পথে চালিত করছে। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় দরকার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও সহযোগিতা।’’ পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি ছেড়ে বাস্তব জীবনের অসাম্য, দারিদ্র্য বা সামাজিক ন্যায়ের মতো বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে গেলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পদ্ধতি নয়, প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেরও ব্যাখ্যা, বললেন নোবেলজয়ী।
আসেমগ্লুর হুঁশিয়ারি: ‘লিবারালিজম’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ
আসেমগ্লুর বক্তব্য ছিল আরও বেশি রাজনৈতিক। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, আজকের লিবারালিজম মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ১৯৫০-৭০-এর দশকে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টেট কমপ্যাক্ট’ বা রাষ্ট্র-শিল্প যৌথ উদ্যোগে কর্মসংস্থান, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি হয়েছিল — যা গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করেছিল। কিন্তু গত তিন দশকে, প্রযুক্তির প্রভাবে (যেমন অটোমেশন, সফটওয়্যার, রোবট) কর্মসংস্থান কমে গেছে। উৎপাদন বাড়লেও শ্রমিকের প্রয়োজন কমে যাওয়ায় শ্রমিক শ্রেণি মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে।

শিক্ষিত এলিট বনাম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী
আসেমগ্লুর মতে, মধ্যবিত্ত, কলেজ-শিক্ষিত এলিট সমাজ যাঁরা বহুদিন ধরেই উদারনৈতিক চিন্তাধারার পক্ষে, তাঁরাই আজ বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে technocratic নীতির পক্ষপাতী। এই নীতিগুলি যেমন কার্বন কর বা means-tested welfare প্রস্তাব করে — যা প্রান্তিক জনগণের কাছে দূরবর্তী, জটিল ও অপ্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, ‘‘একই মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থতা ডেকে আনে। যারা আমাদের মতো ভাবে না, তাদের অবজ্ঞা করলে তারা আরও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি ভারত, তুরস্ক, ব্রাজিলের মতো দেশের উদাহরণ দেন, যেখানে শহরভিত্তিক ‘এলিট’ শ্রেণি ও গ্রামীণ জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজন জনভিত্তির রাজনীতিকে সরিয়ে দিয়েছে এবং পপুলিস্ট শাসকদের উত্থান ঘটিয়েছে।
নতুন সমাধান: কর্মভিত্তিক উদারনীতি
আসেমগ্লু বলেন, ‘‘লিবারালিজমকে বাঁচাতে হলে তা কেবল এলিটদের ‘সহানুভূতির’ ভিত্তিতে নয়, বরং শ্রমিক শ্রেণির স্বশাসনের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করতে হবে।’’ তার জন্য দরকার ভালো কাজ, সম্মানজনক জীবন ও স্থানীয় অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ বাজার বা কর্পোরেট হাতে থাকলে, তা গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলবে। Microsoft, Google, Nvidia-র মতো শক্তিশালী কোম্পানিগুলি ইতিমধ্যেই AI-কে শ্রম-বিনাশী প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে। পরিবর্তে দরকার এমন প্রযুক্তি যা মানুষকে সহায়তা করবে, কর্মসংস্থানের বিকল্প নয়। শুধু কলেজ শিক্ষা নয়, বরং প্রযুক্তি-সক্ষম শ্রমিক তৈরির জন্য প্রয়োজন পুনর্গঠিত কমিউনিটি কলেজ, ট্রেনিং সেন্টার ও অ্যাপ্রেন্টিসশিপ প্রোগ্রাম।
আরও পড়ুন: সাধারণ স্কলারশিপের টাকা আটকে রেখে মোদির প্রচারে ৫২২% বেশি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রের!
রাজনৈতিক ভিত্তি না থাকলে লিবারালিজম টিকবে না
উভয় নোবেলজয়ীই স্বীকার করেন, গত ৪০ বছরের সামাজিক বিজ্ঞান চর্চার ভুল কেবল কার্যকারিতার (commission) নয়, বরং অবহেলার (omission)ও। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সামাজিক প্রভাব নিয়ে কেন্দ্র-বাম বা কেন্দ্র-ডান রাজনৈতিক দলগুলো ভাবেইনি। এই বিভাজনই লিবারালিজমের মূল ভোটব্যাঙ্ককে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই শূন্যতা পূরণে দরকার বহুমাত্রিক, আন্তঃবিভাগীয় উদ্যোগ — যাতে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সম্প্রদায়ভিত্তিক গণতন্ত্রের ভিত আবার শক্ত হয়। অমর্ত্য সেন বলেন, ‘‘সামাজিক ন্যায়ের কোনও মানে হয় না যদি আমরা কেবল নির্দিষ্ট একটি চ্যানেল দিয়ে চিন্তা করি।’’ ভবিষ্যতের দিশা খুঁজতে গেলে দরকার সহাবস্থান, সংলাপ এবং সহযোগিতা — যা কেবল রাজনৈতিক নয়, বৌদ্ধিক ও মানবিকও।
এই দুই অর্থনীতিবিদের কথার মাঝে খুঁজে পাওয়া গেল এমন একটি অভিন্ন সুর — গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে তা মানুষের সঙ্গে, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, বইয়ের পাতায় নয়, জীবনের বাস্তবতাতেই।
