আজকাল ওয়েবডেস্ক: সালটা ১৯৯৯। বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথমবার পা রেখেই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ১১ জন বাঙালি। পাকিস্তানকে হারিয়ে জানান দিয়েছিলেন, ‘আমরাও এসে গিয়েছি’। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম ‘দাদা’দের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে যে লড়তে পারে বাঙালিরাও, সেই প্রথম প্রমাণ দিয়েছিল পদ্মাপারের দেশটা।

২০০৭ বিশ্বকাপে এগারো জন দুর্ধর্ষ বাঙালি ক্রিকেটারের কাছে পরাভূত হয়ে বিশ্বকাপে দৌড় থেমে গিয়েছিল ভারতের। ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাটি ধরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বে একসময়ে বলা হত, ভারত-পাকিস্তানের থেকেও ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট-দ্বৈরথ হয়ে উঠেছে অনেক টেনশনের, অনেক আবেগের।

আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শুরুর আগেই চাপে ভারত, চোট পেয়ে গেলেন এই অলরাউন্ডার

পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? এই ২০২৫-এ আফগানিস্তানের কাছে ৩-০-এ ওয়ানডে সিরিজে হার মানার পর বলতেই হয়, বাংলাদেশ তুমি কি পথভ্রষ্ট হয়েছ? একসময়ে যে ফরম্যাটে শিভ্যালরি দেখিয়েছেন হাবিবুল বাশার-আক্রম খানরা, বিশ্বমঞ্চে বীরগাথা লিখে গিয়েছেন শাকিব আল হাসানরা, সেই পঞ্চাশ ওভারের ফরম্যাটেই বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়ল দুর্দমনীয় আফগানদের কাছে। 

Rashid Khan triggered a middle-order collapse, Afghanistan vs Bangladesh, 2nd ODI, Abu Dhabi, October 11, 2025

সিরিজের বল গড়ানোর আগে থেকে বাংলাদেশ অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ আশার কথা শোনাচ্ছিলেন দেশের মানুষকে। ভাল পারফরম্যান্স তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন। দিনান্তে মিরাজের একটি প্রতিশ্রুতিও মিলল না। প্রতিটি ম্যাচে ব্যর্থতার নজির রাখল বাংলাদেশের এগারো জন সেনানী। 

আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছিল টাইগাররা। দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে গিয়েছিল। মিডল অর্ডার সেই ধস সামলানোর কাজ করে বটে। কিন্তু শেষের দিকে আবার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ব্যাটিং। বাংলাদেশ থামে ২২১ রানে। ৫ উইকেটে সেই ম্যাচ হারার পরে বাংলাদেশ অধিনায়ক মিরাজ বলেছিলেন, ''আমরা প্রথম ১৫ ওভারে বেশি উইকেট হারাই। শেষের দিকে পার্টনারশিপ গড়তে পারিনি। পরের ম্যাচে ছেলেরা ভাল করবে বলেই আমার বিশ্বাস।''

দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের বোলাররা দাপট দেখান। ১৯০ রানে অল-আট হয় আফগানরা। কিন্তু সেই ব্যাটিং আবার বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। ১০৯ রানে অল-আউট হয়ে যায় বাংলার বাঘেরা। দুই ম্যাচ হারের পরে মিরাজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ''আরও একটা ম্যাচ বাকি রয়েছে। ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে হবে।'' সেই বাংলাদেশ ২৯৩ রান তাড়া করতে নেমে ৯৩ রানেই ধসে গেল। ২০০ রানে ম্যাচ জিতে আফগানিস্তান হোয়াইট ওয়াশ করল মিরাজদের। 

আজই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঢাকায় পা রাখবে। মিরাজ বলছেন, ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে ভাল ফল করার চেষ্টা করবেন তাঁর ছেলেরা। বলছেন বটে, কিন্তু সেই কথায় কি আত্মবিশ্বাস রয়েছে? এই বিপর্যয় সামলে উঠে ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে কি অন্য অবতারে ধরা দিতে পারবেন টাইগাররা? বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে এখন প্রশ্ন অনেক। 

Bilal Sami got his maiden five-for, Afghanistan vs Bangladesh, 3rd ODI, Abu Dhabi, October 14, 2025

আজকাল ডট ইনের কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেট-বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে বসে 'ক্রীড়ালোক' সংবাদ মাধ্যমের ক্রীড়া সাংবাদিক রিয়াজুল ইসলাম শুভ বলেন, ''ওয়ানডে ফরম্যাটে আগে ভাল খেলত বাংলাদেশ। সেই চেনা, পছন্দের ফরম্যাটেই এখন হতশ্রী ক্রিকেট খেলছি আমরা। সিনিয়র ক্রিকেটারদের না থাকা বাংলাদেশ দলকে দুর্বল করে দিয়েছে।''

অতীতে ভারত, শ্রীলঙ্কা থেকে তারকা ক্রিকেটাররা বাংলাদেশে গিয়ে খেলেছেন। এমন নজির রয়েছে। অন্য দেশের ক্রিকেটারদের উপস্থিতিতে ফুল ফুটেছিল পদ্মাপারের দেশে।রিয়াজুলের ব্যাখ্যা,  ''এতে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই উন্নতি ঘটেছিল। টেস্ট খেলিয়ে দেশের স্ট্যাটাস পেয়েছিলাম আমরা।''

 সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। ধীরে ধীরে অস্তাচলে গিয়েছেন মাশরাফি মোর্তাজা, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিকুর রহিমরা। বছর খানেকের বেশি হয়ে গেল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার শাকিব আল হাসান খেলছেন না সে দেশের জার্সিতে।

ক্যারিবিয়ান-ভূমে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারতের দৌড় থামিয়ে দিয়েছিল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন  বাংলাদেশ। সেই প্রাক্তন অধিনায়ক বলছেন, ''ওয়ানডে সিরিজে আফগানিস্তানের কাছে আমরা হেরে গিয়েছি ঠিক কথা। কিন্তু এই সিরিজের আগে বাংলাদেশ কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে হারিয়েছে। আমাদের সিনিয়র ক্রিকেটাররা সরে যাওয়ার পরে এখন যাদের নিয়ে মিডল অর্ডার তৈরি করা হয়েছে, সেখানে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার অভাব বড্ড বেশি করে চোখে পড়ছে। শাকিব আল হাসান, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিকুর রহিমরা সরে যাওয়ায় যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তা আর ভরাট করা এই মুহূর্তে সম্ভব হয়নি।'' 

অভিজ্ঞ হাবিবুল বাশার আলো ফেলছেন অন্য জায়গায়। তিনি বলছেন, ''টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট ছোট। সেখানে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ-শাকিবদের অভাব বোধ হচ্ছে না। দুর্বলতাও এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফরম্যাট যখনই দীর্ঘ হয়ে উঠছে,তখনই দক্ষতা-অভিজ্ঞতার অভাবটা প্রকট হয়ে উঠছে। এটাই সমস্যা।'' 

Mehidy Hasan Miraz and Towhid Hridoy rebuilt for Bangladesh, Afghanistan vs Bangladesh, 1st ODI, Abu Dhabi, October 8, 2025

কিন্তু এই শূন্যস্থান কি ভরাট করা সম্ভব? রিয়াজুল বলেন, ''ভারতেও সুনীল গাভাসকর সরে গিয়েছেন। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে চলে এসেছিলেন শচীন তেণ্ডুলকর। তিনি সরে যাওয়ার পরে এসেছেন বিরাট কোহলি। শচীন-বিরাটরা ভারতীয় ক্রিকেটকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। একদিন সবারই সময় শেষ হবে। সেই জায়গায় নতুনদের তুলে আনতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে সেইরকম গুণগত মানসম্পন্ন ক্রিকেটার উঠে আসছে না। তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ম্যাচে।''

বাংলার বাঘেরা এখন পুরো পঞ্চাশ ওভারও ব্যাট করতে পারে না। শেষ ১০টি ওয়ানডে-র মধ্যে মাত্র দু'টিতে বাংলাদেশ কেবল অল-আউট হয়নি। বাংলাদেশ কি এখন ওয়ানডে ক্রিকেট খেলতে ভুলে গিয়েছে? সে দেশের সাংবাদিক, প্রাক্তন অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলার পরে সুমনের গানের লাইন ধরে বলাই যায়, "প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।'' 

আরও পড়ুন: উত্তপ্ত কিশোর ভারতী, বিক্ষোভ-লাঠিচার্জ, দিমিদের আক্রমণ সমর্থকদের...