আজকাল ওয়েবডেস্ক: দেড় বছর আগে জুলাই অভ্যুথ্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। তাঁর বক্তব্যে তৈরি হয়েছিল শক্তিশালী অনুগামী বলয়, আবার জন্ম দিয়েছিল বহু বিতর্কের। বৃহস্পতিবার রাতে ভারত 'বিরোধী' ওসমানের মৃত্যুর খবর বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকা জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। ভারত বিরোধী সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা হাদি ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় অজ্ঞাত আততায়ীদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন এবং সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মহম্মদ ইউনূস হাদির মৃত্যুর ঘোষণার পরই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। শোক প্রকাশের সঙ্গেই বলেন, শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে ১৯ ডিসেম্বর (আজ, শুক্রবার) বাংলাদেশের সকল উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
২০২৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন হবে। তার আগে হাদির মৃত্যু প্রতিবেশী দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলেছে। নির্বাচন ঘোষণার ঠিক পর পরই হাদিকে আক্রমণ নিয়েও নানা প্রশ্ন উটে আসছে। পুলিশের মতে, যখন মধ্য ঢাকার বিজয়নগর এলাকায় নির্বাচনী প্রচারর শুরুর প্রস্তুতি করছিলেন হাদি তখনই তিনজন হামলাকারী একটি মোটরসাইকেলে করে এসে তাঁকে গুলি করে। এই এলাকা থেকেই তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে স্থির ছিল।
সংবদান সংস্থা পিটিআই-কে উদ্ধৃত করে ঢাকা পুলিশের একজন মুখপাত্র বলেছেন, "দুপুর ২.২৫ নাগাদ বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোডের ডিআর টাওয়ারের সামনে ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি যে, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা তিনজন হামলাকারী তাঁকে গুলি করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।" রক্তাক্ত হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ডিএমসিএইচ) ভর্তি করা হয়, সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। পরে অন্তর্বর্তী সরকার আরও ভাল চিকিৎসার জন্য জখম হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে, গুরুতর আহত ৩২ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা বৃহস্পতিবার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইউনূস, জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন, হত্যাকারীদের প্রতি “কোনও নমনীয়তা দেখানো হবে না।" তিনি শনিবার একদিনের শোক ঘোষণা করে বলেন, "সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।"
হাদি- আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের এক অন্যতম মুখ
শরিফ ওসমান হাদি এবং তাঁর সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ দেশের জুলাই-আগস্ট (২০২৪ সালের) গণঅভ্যুত্থানে প্রধান মুখ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পতন তরান্বিত করেছিল। তাঁকে তীব্র ভারতের বিরোধী এবং জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের একজন “অগ্রগণ্য” যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
গত এক বছরে ইনকিলাব মঞ্চ একটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই দল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করতে মরিয়া। ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের মে মাসে হাসিনার আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে জানায়।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর মতে, এই গোষ্ঠীটি বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের 'সকল হামলাকারী'কে গ্রেপ্তার এবং 'জুলাই যোদ্ধাদের' নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জোরদার আবেদন জানিয়েছে।
হাদির উপর এই হামলা ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে।
এর আগে গত রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'উস্কানিমূলক বক্তব্যের' বিষয়ে 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক ইঙ্গিত দেয় যে, এই মামলার অভিযুক্ত হামলাকারীরা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। মন্ত্রণক আরও বলেছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা শরিফ ওসমান হাদির ওপর সাম্প্রতিক হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনদের ভারতে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে এবং যদি তারা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তবে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের জন্য ভারত সরকারের সহযোগিতার আবেদন করা হচ্ছে।
এর আগে ইনকিলাব মঞ্চটি হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে, হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত তারা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান ধর্মঘট করবে। পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, তারা বলেছে, "যদি হত্যাকারী ভারতে পালিয়ে যায়, তবে ভারতীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যেকোনও মূল্যে তাদের গ্রেপ্তার করে ফিরিয়ে আনতে হবে।"
বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভে ভারতবিরোধী স্লোগান দেওয়া হয় এবং ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির মতো রাজনৈতিক শাখাগুলো অভিযোগ করে যে- হাদির হামলাকারীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ইতিমধ্যেই ভারতে পালিয়ে গিয়েছে। তারা হামলাকারীদের ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশন বন্ধ করে দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। এনসিপি-র একজন শীর্ষ নেতা সারজিস আলম বলেন, "যতক্ষণ না ভারত হাদি ভাইয়ের হত্যাকারীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে, ততক্ষণ বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন বন্ধ থাকবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি!"
যদিও ইউনূস দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং "প্রচারণা ও গুজব থেকে দূরে থাকতে এবং কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকতে" পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাদিকে "পরাজিত শক্তি ও ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসবাদীদের শত্রু" হিসেবে বর্ণনা করেন। যা স্পষ্টতই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি ইঙ্গিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, "বিপ্লবীদের ভয় দেখানোর জন্য তাদের অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হবে।"
এর আগে, হামলার প্রতিক্রিয়ায় মহম্মদ ইউনূস দাবি করেছিলেন যে, "ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হল নির্বাচনকে বানচাল করা। এই হামলা প্রতীকী - এর উদ্দেশ্য হল তাদের শক্তি প্রদর্শন করা।"
