আজকাল ওয়েবডেস্ক: সকালে ঘুম ভাঙতেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আসা এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার ভিডিও, বসার ঘরে চলতে থাকা নিউজ চ্যানেলে রাজনৈতিক তরজার তীব্র কোলাহল, সোশ্যাল মিডিয়া খুলতেই যুদ্ধ, হানাহানি আর অর্থনৈতিক মন্দার দুঃসংবাদ। প্রতি মুহূর্তে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর এই অবিরাম স্রোত কি আপনাকে ক্লান্ত, বিরক্ত বা হতাশ করে তুলছে? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আপনি একা নন। এমন ক্লান্তির শিকার আরও হাজারো মানুষ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকেই বলা হচ্ছে ‘নিউজ ফ্যাটিগ’ বা খবরজনিত ক্লান্তি।
‘নিউজ ফ্যাটিগ’ হল এমন এক মানসিক অবস্থা, যখন কোনও ব্যক্তি অতিরিক্ত দেখার ফলে মানসিক এবং শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এর লক্ষণগুলি খুব সহজেই চেনা যায়। খবর দেখলেই উদ্বেগ বা বিরক্তি বোধ করা, অসহায় লাগা, ঘুমের সমস্যা, মনঃসংযোগে অসুবিধা এবং শেষ পর্যন্ত সব ধরনের খবর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। ডিজিটাল যুগে চব্বিশ ঘণ্টা খবরের সহজলভ্যতা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভুয়ো বা অর্ধসত্য খবরের ছড়াছড়ি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশেষত নেতিবাচক এবং চাঞ্চল্যকর খবরগুলি আমাদের মস্তিষ্কে গভীর প্রভাব ফেলে, যা থেকে জন্মায় দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ।
কিন্তু একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে খবর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকাও তো সম্ভব নয়। তাহলে এই ক্লান্তি থেকে মুক্তির উপায় কী? মনোবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পথের কথা বলছেন।

১। খবর গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ: সারাদিন ধরে খবর না দেখে বা পড়ে, দিনের একটি বা দুটি নির্দিষ্ট সময় (যেমন- সকালে আধ ঘণ্টা এবং সন্ধ্যায় আধ ঘণ্টা) বেঁধে নিন। এই নিয়মানুবর্তিতা আপনাকে তথ্যের সাগরে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচাবে।
২। নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম নির্বাচন: একসঙ্গে দশটি নিউজ পোর্টাল বা চ্যানেল না দেখে, কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমকে বেছে নিন। এতে খবরের সত্যতা যেমন বজায় থাকবে, তেমনই অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভিড় থেকেও মুক্তি মিলবে।
৩। ডিজিটাল ডিটক্স: ফোনের নিউজ অ্যাপগুলির অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন। ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর আকর্ষণ ত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। সপ্তাহে অন্তত একটি দিন বা দিনের নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা নিজেকে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে সরিয়ে রাখুন।
৪। ইতিবাচক খবরের সন্ধান: খবরের দুনিয়া মানেই শুধু দুঃসংবাদ নয়। চারপাশে ঘটে চলা অনেক ভাল এবং অনুপ্রেরণামূলক ঘটনার খবরও পড়ুন। বিজ্ঞান, কলা, খেলাধুলা বা সাধারণ মানুষের সাফল্যের কাহিনি আপনার মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৫। অফলাইন জীবনে মনোযোগ: খবরের দুনিয়ার বাইরেও একটা বাস্তব জীবন আছে। বই পড়া, পছন্দের সিনেমা দেখা, বাগান করা, খেলাধুলা বা প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। মাটির সঙ্গে সংযোগ এবং মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলাই হল ডিজিটাল ক্লান্তির সেরা ওষুধ।
মনোবিদদের মতে, সচেতন থাকা এবং আতঙ্কিত হওয়ার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। নিউজ ফ্যাটিগ আমাদের সেই রেখা পার করিয়ে দেয়। আমাদের তথ্যের উপভোক্তা হতে হবে, শিকার নয়। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের সীমানা রচনা করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই।
সুতরাং, বিশ্ব সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি, কিন্তু তা নিজের মানসিক শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে নয়। সচেতন নাগরিক হওয়ার অর্থ সারাদিন খবরে ডুবে থাকা নয়, বরং পরিমিত পরিমাণে সঠিক খবর গ্রহণ করে নিজের জীবনে এগিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
