আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভ্লাদিভস্তকে অনুষ্ঠিত ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামে রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আন্না সিভিলিয়োভা এক বিস্ময়কর মন্তব্য করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত রুশ সেনাদের কারণে রাশিয়া এখন বিশ্বে কৃত্রিম অঙ্গ (প্রস্থেটিক লিম্ব) তৈরিতে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে পৌঁছেছে। সিভিলিয়োভা, যিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আত্মীয় বলে পরিচিত, বলেন—“বিশেষ সামরিক অভিযানের অংশগ্রহণকারীরাই আমাদের এই ক্ষেত্রে এক ‘ফ্ল্যাগশিপ লেভেল’-এ পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা সম্ভবত এখন এই খাতে বিশ্বের শীর্ষে।”

রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত সংখ্যা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে আন্তর্জাতিক সূত্র বলছে, বাস্তব চিত্র ভয়াবহ।ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের  হিসাবে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া পূর্ণমাত্রার আক্রমণের পর থেকে ১০ লক্ষেরও বেশি রুশ সেনা নিহত বা আহত হয়েছে। মার্কিন থিংক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS) অনুমান করছে, কেবলমাত্র নিহতের সংখ্যা আড়াই লাখের কাছাকাছি, আর আহতসহ মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯.৫ লক্ষাধিক। এই বিপুল আহত সৈন্যরা দেশে ফিরছে হাত-পা হারিয়ে, যা কৃত্রিম অঙ্গশিল্পকে অস্বাভাবিকভাবে ত্বরান্বিত করেছে।

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের 'তুঘলক' নীতিতে দিশাহারা অবস্থা, ২৫০ বছরে এই প্রথম এক বড় সংকটের সামনে আমেরিকা!

রুশ সরকারি তথ্য অনুযায়ী—২০২১ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ৬০ হাজার বেশি প্রস্থেটিক লিম্ব সরবরাহ করা হয়েছে, যা ৬৫% বৃদ্ধি যুদ্ধবিধ্বস্ত সৈন্যদের জন্য এই শিল্প এখন রাষ্ট্রের একটি অগ্রাধিকার ক্ষেত্র  হিসেবে গড়ে উঠছে। একইসঙ্গে, রাশিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ক্ষেত্র'ও  অস্বাভাবিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে এই শিল্পে আয় বেড়েছে ১২.৭%, যা উচ্চ মৃত্যুহারের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। আন্না সিভিলিয়োভা কেবলমাত্র উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নন, তিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। যুক্তরাজ্য তাঁকে বর্ণনা করেছে “পুতিনের ফার্স্ট কাজিন ওয়ান্স রিমুভড” হিসেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁকে উল্লেখ করেছে পুতিনের “ঘনিষ্ঠ আত্মীয়” বলে। ইউক্রেন যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর ভূমিকাকে ঘিরে সিভিলিয়োভাকে ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।

একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুল রক্তক্ষয়ী বাস্তবতা—অন্যদিকে সেই ক্ষয়ক্ষতি থেকেই উঠে আসা এক নতুন শিল্পখাতের উল্লম্ফন। রাশিয়া যে “বিশ্বনেতা” হয়েছে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরিতে, সেটি হয়তো প্রযুক্তিগত সাফল্যের দাবি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত সত্য হলো যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার হাজার সৈন্যের প্রাণ ও অঙ্গহানি। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। মস্কো এটিকে “বিশেষ সামরিক অভিযান” নামে প্রচার করলেও, বাস্তবে এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের সবচেয়ে বড় সামরিক সংঘাত। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত কিয়েভ দখল করে সরকারকে উৎখাত করা, কিন্তু ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

যুদ্ধ চলতে চলতে দুই বছর পেরিয়ে এখন এটি রূপ নিয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষয়িষ্ণু সংঘাতে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও মার্কিন গবেষণা কেন্দ্রগুলোর হিসাব অনুযায়ী রাশিয়ার নিহত-আহতের সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। ইউক্রেনও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে—লক্ষাধিক বেসামরিক মানুষ বাস্তুচ্যুত, পরিকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত, অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায়। এই যুদ্ধকে ঘিরে ভূরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ দেখা দিয়েছে। ন্যাটো দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সমর্থন দিচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ এখনো নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু দুই দেশের সীমান্তেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিশ্ব  খাদ্য, জ্বালানি ও নিরাপত্তা সংকটকে গভীর করেছে, যা আগামী দিনের বিশ্বরাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে।