আজকাল ওয়েবডেস্ক: বেইজিং শহরে ফেরার পর ভোরবেলা আবহাওয়া অ্যাপ দেখে চমকে উঠলেন এক প্রবাসী ভারতীয় গবেষক। তাপমাত্রা নয়, বিস্ময়ের কারণ হলো AQI বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। মাত্র ১৩—যা সাধারণত ইউরোপের গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়। অথচ ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেইজিংয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রায়ই দেখেছেন AQI সূচক ৭০০-র উপরে উঠে যেত, যা যন্ত্র দিয়ে মাপাও সম্ভব হতো না।

১৬ বছর পর চীনে ফিরে তিনি আবিষ্কার করলেন এক অন্য বেইজিং। শহরের আকাশ আজ স্বচ্ছ নীল, দিগন্তে ফুটে উঠছে পশ্চিমের সবুজ পাহাড়। অথচ একসময় এই পাহাড় দূষণের কুয়াশায় পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যেত। এককথায়, দূষণের শহর আজ পরিণত হয়েছে পরিচ্ছন্নতার প্রতীকে।

চীন রাতারাতি এই পরিবর্তন আনেনি। ২০০৮ অলিম্পিকের আগেই দেশের অধিকাংশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সালফার ডাই অক্সাইড নিয়ন্ত্রণের আধুনিক যন্ত্র বসানো হয়েছিল। পরে নাইট্রোজেন অক্সাইড নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিও চালু হয়। তারপর ধাপে ধাপে পুরনো ইটভাটা ও দূষণকারী শিল্প কারখানা বন্ধ বা আধুনিকীকরণ, কঠোর গাড়ির নির্গমন মানদণ্ড, প্রাকৃতিক গ্যাস ও নতুন করে ব্যবহারযোগ্য শক্তির প্রচলন, এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন (EV) প্রচারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বচ্ছ বাতাস ফিরে এসেছে।

২০১৪ সালে সংশোধিত পরিবেশ আইন অনুযায়ী, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা না মানলে কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের আটক করা সম্ভব হয়। জরিমানারও আর কোনো সীমা থাকেনি। পাশাপাশি বেইজিং একা নয়—তিয়ানজিন ও হেবেই প্রদেশের সঙ্গে সমন্বিত নীতি গ্রহণের পরই প্রকৃত সাফল্য আসে।

আরও পড়ুন:   কুরশিতে বসছেন না কারকি! অন্তবর্তী সরকার চালাতে কুলমনের কাছে জেন জি-রা? নেপালে ছবি বদলাচ্ছে বেলায় বেলায়

চীন আজ বিশ্বের বৃহত্তম সোলার প্যানেল, উইন্ড টারবাইন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র উৎপাদক। চলতি বছরের জুলাই মাসে চীনের বিদ্যুৎ খরচ দাঁড়ায় ১.০২ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা—যা জাপানের বার্ষিক খরচের চেয়েও বেশি। অবাক করা তথ্য হলো, এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ এসেছে বায়ু, সৌর ও বায়োমাস শক্তি থেকে। শুধু তাই নয়, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে নতুন করে ব্যবহারযোগ্য শক্তি নতুন বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি পুরনো কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও প্রতিস্থাপন করতে শুরু করেছে। ফলে চীনের কার্বন নিঃসরণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

বেইজিংয়ের রাস্তায় চোখে পড়ে অসংখ্য সবুজ নাম্বার প্লেটধারী বৈদ্যুতিক গাড়ি। জুলাই মাসে দেশে নতুন গাড়ি বিক্রির ৫১% ছিল বৈদ্যুতিক বা হাইব্রিড। বড় শহরগুলোয় এ হার ৬০-৭০ শতাংশের কাছাকাছি। কঠোর দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি প্রণোদনার ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ি এখন মূলধারার বাজার দখল করছে।

মুতিয়ানইউ গ্রেট ওয়াল অঞ্চলের একটি পুরনো ইটভাটা বন্ধ হয়ে ২০১০ সালে পরিণত হয় ব্রিকইয়ার্ড রিট্রিট নামক এক বুটিক হোটেলে। ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা গ্রাম বেইগো আজ শহুরে পর্যটকদের কাছে শান্তিপূর্ণ অবকাশকেন্দ্র। এখানেই কর্মরত আছেন ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা নিতিন গণেশচাঁদ কালা, যিনি হোটেলের ফ্রন্ট অফিস ম্যানেজার। তিনি বলেন, “ভারতকে ভালোবাসি, কিন্তু এখানে মানুষ বেশি পরিপক্ব। রাস্তাঘাটও ভারতের তুলনায় অনেক উন্নত।” গ্রামের এক স্থানীয় ড্রাইভারও নতুন করে বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনেছেন। ৩ লাখ ইউয়ান খরচ করে কেনা নিসান গাড়ি চালিয়ে তিনি গর্বের সঙ্গে বললেন, “খারাপ না, তাই না? সাধারণ মানুষের জন্যও মন্দ নয়।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের দূষণপীড়িত শহরগুলির জন্য চীনের এই সাফল্য এক বড় শিক্ষা। দূষণ মানুষের তৈরি সমস্যা, তাই সমাধানও মানুষের হাতেই। প্রয়োজন কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর আইন প্রয়োগ, শিল্প ও নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা, এবং আঞ্চলিক সমন্বিত পরিকল্পনা।