আজকাল ওয়েবডেস্ক: SIR-এ সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছেন বিজেপিকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ভোট দেওয়া মতুয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী, সবচেয়ে কম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন সংখ্যালঘুরা। আরেকটা বড় ধাক্কা এসেছে শহরাঞ্চল এবং শিল্প-শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে। তালিকায় নাম না ওঠার সংখ্যায় এগিয়ে এই অঞ্চলগুলো। মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপির 'ঘুসপেটিয়া' ন্যারেটিভ, প্রকট হয়ে উঠেছে রাজ্যে জীবিকার সংকট।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনের খসড়া ভোটার তালিকা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত বিজেপির এক গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক প্রচারকে কার্যত প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। কমিশনের নির্দেশে ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে বর্তমান ভোটারদের তথ্য মিলিয়ে দেখার এই প্রক্রিয়া বিজেপির বহুল প্রচারিত “অবৈধ বাংলাদেশি” বা “রোহিঙ্গা ভোটার” তত্ত্বকে পরিসংখ্যানের নিরিখে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্যা ওয়্যার-এর একটি বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সীমান্তবর্তী সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকাগুলিই বরং সবচেয়ে বেশি নাম নথিভুক্ত করেছে ও যাবতীয় নথি প্রমাণ হিসেবে জমা করেছে। বিপরীতে তথাকথিত “নাগরিকত্ব সংকট” সবচেয়ে তীব্র আকার নিয়েছে হিন্দু শরণার্থী ও শহুরে শ্রমজীবী জনসংখ্যার মধ্যে। ২০২৫ সালের এসআইআর কাঠামো অনুযায়ী বর্তমান ভোটারদের ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে নিজেদের উপস্থিতি ‘ম্যাপ’ করতে বলা হয়েছে। যাঁরা এই যোগসূত্র প্রমাণ করতে পারছেন না, তাঁরা পড়ছেন “নো ম্যাপিং” শ্রেণিতে, যেখানে অতিরিক্ত ডকুমেন্ট ও বাধ্যতামূলক শুনানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পাশাপাশি, অনুপস্থিত, বাসস্থান বদলেছেন এমন, মৃত ও ডুপ্লিকেট ভোটারদের আলাদা করে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যটি হলো সংখ্যালঘু ভোটারদের নাম নথিভুক্ত করার বিষয়। বিজেপির রাজনৈতিক বয়ানে সীমান্তবর্তী সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলাগুলিকে অবৈধ অনুপ্রবেশের কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরা হলেও এসআইআর তথ্য ঠিক উল্টো ছবি দেখাচ্ছে। এই এলাকাগুলিতে ‘নো ম্যাপিং’ হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মুর্শিদাবাদ জেলা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ডোমকল (৭৭.৬৭ শতাংশ মুসলিম) কেন্দ্রে নো ম্যাপিং মাত্র ০.৪২ শতাংশ, রানিনগরে (৭৫.৪০ শতাংশ মুসলিম) ০.৯১ শতাংশ এবং হরিহরপাড়ায় (৭৪.৯৬ শতাংশ মুসলিম) ০.৬০ শতাংশ। এই তথ্য প্রমাণ করে গ্রামীণ সংখ্যালঘু মানুষের জন্মস্থান সংক্রান্ত উপযুক্ত প্রমাণ রয়েছে, যার ফলে ২০০২ সালের কাট-অফের সঙ্গে তাঁদের বর্তমান তথ্য মিলিয়ে নেওয়ার কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ হয়েছে। পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার যত বেশি, নাম নথিভুক্তিতে জটিলতার হার তত কম, ফলে বিজেপির “অবৈধ অনুপ্রবেশ” তত্ত্বের কোনও বাস্তব ভিত্তি থাকছে না।
এর ঠিক বিপরীতে সবচেয়ে বেশি নো ম্যাপিং হার দেখা যাচ্ছে মতুয়া অধ্যুষিত বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে। নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার ১৭টি মতুয়া-প্রধান কেন্দ্র বিশ্লেষণ করে দ্যা ওয়্যার-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেখানে গড় নো ম্যাপিং হার ৯.৪৭ শতাংশ, যা রাজ্য গড় ৪.০৫ শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি। এই কেন্দ্রগুলিতে তফসিলি জাতির গড় জনসংখ্যা প্রায় ৩৬.৩৯ শতাংশ, অথচ সংখ্যালঘু জনসংখ্যা মাত্র ১৩.৬৬ শতাংশ। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা, যা মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, সেখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা মাত্র ৭.৬১ শতাংশ হলেও নো ম্যাপিং হার ১৪.৫১ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৩৮ হাজার ৪৯০ ভোটার। পাশের বাগদা কেন্দ্রেও একই ছবি উঠে এসেছে। সেখানে সংখ্যালঘু ১১.৯৭ শতাংশ, অথচ নো ম্যাপিং ১২.৬৯ শতাংশ বা প্রায় ৩৬ হাজার ৫৬৭ ভোটার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০২ সালের কাট-অফ কার্যত সেই হিন্দু শরণার্থীদের জন্য একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাঁরা ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে বা পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে পশ্চিমবঙ্গে এসে বসতি গড়েছিলেন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) যাঁদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলেছিল, এসআইআর প্রক্রিয়াই তাঁদের নাগরিকত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে, যা বিজেপির রাজনৈতিক ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়।
সীমান্ত অঞ্চল ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের শহরগুলোতে দেখা যাচ্ছে আরেকটি ট্রেন্ড। কলকাতা ও আশপাশের শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলিতে ভোটার তালিকা থেকে ব্যাপক হারে নাম ব্যাড পড়ছে। জোড়াসাঁকোতে প্রায় ৩৬.৮৫ শতাংশ এবং চৌরঙ্গিতে ৩৫.৪৬ শতাংশ ভোটার বাদ পড়েছেন। জেলাভিত্তিক হিসাবেও কলকাতা উত্তর ও দক্ষিণে যথাক্রমে ২৫.৯৩ ও ২৩.৮৩ শতাংশ ভোটার ডিলিট হয়েছে। এই ঘটনা সংখ্যালঘু কম হোক বা বেশি, শহরের বাণিজ্যিক ও পরিষেবা কেন্দ্রগুলিতে জনসংখ্যার দ্রুত বদলের মূল কারণ। এর ফলে ২০২৬ সালের নির্বাচনের অঙ্কে বড়সড় অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শিল্পাঞ্চলগুলিতেও একই সঙ্গে নো ম্যাপিং ও নাম বাদ যাওয়ার হার বেশি। ব্যারাকপুর–হাওড়া শিল্প করিডরে বালি, হাওড়া উত্তর, ভাটপাড়া, আসানসোল উত্তরের মতো কেন্দ্রে শ্রমিকদের রাজ্য বা শহর ছাড়ার ছাপ স্পষ্ট। বহু ভোটারকে “স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, আবার বহু মানুষ বছরের পর বছর ভাড়া বাড়ি বদলানোর কারণে পুরনো নথি জোগাড় করতে পারছেন না।
সব মিলিয়ে এসআইআর ২০২৫ ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ভোটারদের ঝাড়াই বাছাই করেছে। শরণার্থী ও ঘনঘন ঠিকানা বদল করা শহুরে শ্রমজীবীরাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন, আর যাঁদের বিরুদ্ধে “বহিরাগত” তকমা সাঁটা হয়েছিল, সেই গ্রামীণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি নাম নথিভুক্ত করে নাগরিক হিসেবে প্রমাণ দিতে পেরেছেন। ২০২৬ সালের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই তথ্য শুধু এক রাজনৈতিক বয়ান নয়, ভোটারের বৈধতার প্রশ্নকেও নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
