আজকাল ওয়েবডেস্ক: ইজরায়েল প্রায় ২২ মাস ধরে যেভাবে গাজা উপত্যকার ওপর গণহত্যামূলক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, তা আধুনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। নির্বিচার বিমান হামলা, অনাহারে মারার কৌশল, ও সাহায্যপ্রার্থীদের উপর গুলি বর্ষণের মাধ্যমে গাজার প্রতিটি কোণ আজ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই বর্বর আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৫৯,১০৬ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি।
সোমবার, ২১ জুলাই, ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজা শহরের একটি কিন্ডারগার্টেনে বোমা ফেলে। একাধিক শিশু আহত হয়, ভিডিওতে দেখা যায়, ভীতসন্ত্রস্ত শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ওই দিনই আরও একাধিক “নিরাপদ অঞ্চল”, যেমন দেইর আল-বালাহ, নুসাইরাত শরণার্থী শিবির, ওয়াদি গাজা, খান ইউনুস এবং জাবালিয়ার মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিকে লক্ষ্য করে চালানো হয় প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ। তাতে বহু মানুষ নিহত ও আহত হন।
সোমবারের আরেকটি বর্বর অভিযানে, ইজরায়েলি বিশেষ বাহিনী রেড ক্রস হাসপাতালের আশেপাশে একাধিক প্যালেস্টাইনিকে গুলি করে হত্যা করে। এই হামলায় সাংবাদিক তামের আল-জানিন নিহত হন এবং তাঁর সহকর্মী ইব্রাহিম আবু আশিবা গুরুতর জখম হন। অপহরণ করা হয় গাজার ফিল্ড হাসপাতালের পরিচালক ও আবু ইউসুফ আল-নাজ্জার হাসপাতালের প্রধান ডা. মারওয়ান আল-হামসকে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চরম লঙ্ঘন এবং একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধাপরাধ বলে নিন্দা জানিয়েছে।
ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র বানিয়েছে ইজরায়েল
গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ইজরায়েলের মানবিক সাহায্য রোধ করার সিদ্ধান্তের পর। মার্চ ২০২৫-এ ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় সমস্ত রকম সাহায্য পাঠানো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। ফলে গত কয়েক সপ্তাহেই অনাহারে মারা গেছেন অন্তত ১০১ জন, যার মধ্যে ৮০ জনই শিশু। জেনেভাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর তাদের ২৮ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইজরায়েলকে অভিযুক্ত করেছে একটি “সংগঠিত অনাহার নীতির” জন্য, যা “একটি জাতিকে সমগ্রভাবে দুর্বল করে দমন করার জন্য পরিকল্পিত।”
পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মে মাসের শেষের দিকে কিছু পরিমাণ খাদ্য গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইজরায়েল। তবে সেই ত্রাণের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিতর্কিত US-Israeli Gaza Humanitarian Foundation (GHF)-এর হাতে, যারা কথিত মানবিক সাহায্যের আড়ালে মৃত্যুকূপ বানিয়েছে। সেখানে অন্তত ১০০০ মানুষ খাদ্যের আশায় গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়াও, ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর মদতে গঠিত স্থানীয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলি জাতিসংঘের সাহায্য লুট করে এবং তা বাজারে বিক্রি করছে। এমনকি অভিযোগ উঠেছে, এই মিলিশিয়ারাই বহুক্ষেত্রে ক্ষুধার্ত মানুষদের হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড়
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজায় সাহায্যপ্রার্থীদের ওপর গুলি বর্ষণ ও শিশুদের অনাহারে মৃত্যুকে “অমানবিক ও নিষ্ঠুর” আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “গাজায় মানুষের বেঁচে থাকার শেষ ভরসাগুলোও আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।” একই দিনে ২৮টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “গাজার যুদ্ধ এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। শিশু ও সাধারণ মানুষ যখন জল ও খাদ্যের জন্য জীবন দিচ্ছে, তখন কোনো সভ্য রাষ্ট্র এমন নিষ্ঠুর নীতি অনুসরণ করতে পারে না।”
তাঁরা আরও বলেন, “ইজরায়েলের এই তথাকথিত সাহায্য সরবরাহ মডেল বাস্তবে অমানবিক, যা জনগণকে মর্যাদাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী ইজরায়েলকে অবশ্যই তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।” ২২ মাসে গাজা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল এমনকি শিশুদের কিন্ডারগার্টেন — কোনো স্থানই রেহাই পায়নি। ইজরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু এখনো যুদ্ধ বন্ধের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
গাজার প্রতিটি শিশুর কান্না, প্রতিটি মায়ের শোক, এবং প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ইট যেন বিশ্ব বিবেকের সামনে এক একটি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে — আর কত মৃত্যু, আর কত জল, আর কত ক্ষুধা লাগবে এই গণহত্যাকে থামাতে?
