আজকাল ওয়েবডেস্ক: গুরগাঁওয়ে সম্প্রতি যে ধরপাকড় চালানো হয়েছে, তাতে বাংলা ভাষাভাষী অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে চরম আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও অসম থেকে আসা র্যাগপিকার, পরিচারিকা, নির্মাণ শ্রমিকদের টার্গেট করে বহুজনকে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। এখন পর্যন্ত আটককৃতদের মধ্যে মাত্র ১০ জনকে “নিশ্চিত বাংলাদেশি নাগরিক” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বাকিদের প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গুরগাঁও পুলিশ আধিকারিক সন্দীপ কুমার জানান, "শুধুমাত্র ১০ জন এখনো আটক আছেন, যাঁরা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশি বলে শনাক্ত হয়েছেন।" তবে কতজনকে মোট আটক করা হয়েছিল বা ছাড়া হয়েছে, সেই সংখ্যা তিনি প্রকাশ করতে চাননি।
আটকদের মধ্যে অনেকেই বলছেন, শুধুমাত্র অসম বা বাংলা থেকে আসা হওয়ার কারণে তাঁদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোকরাঝাড় জেলার বাসিন্দা রফুকুল ইসলাম জানান, “আমরা বললাম অসম থেকে এসেছি। পুলিশ বলল, না, না, তোমরা বাংলাদেশি। গাড়িতে ওঠো।” তাঁকে ১৮ জুলাই ধরে নিয়ে গিয়ে পাঁচদিন ধরে বসাপুর সিটি সেন্টারের এক ‘হোল্ডিং ক্যাম্প’-এ রাখা হয়। পরে ২৩ জুলাই মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও তিনি আতঙ্কের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন। রফুকুল জানান, “প্রায় ১৫০ জন ছিল আমাদের সঙ্গে। তার মধ্যে ১৫-১৬ জন হিন্দু আগে ছাড়া পেয়েছে। বাকিরা অসম ও বাংলার মুসলিম ছিল।” পুলিশ ছাড়ার সময় তাঁদের কেবল কিছু কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে বলে, “তোমরা এখন চলে যাও, হয়ে গেছে।” অনেকের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যা এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি।
এই ধরপাকড় নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে “ভাষাগত সন্ত্রাসবাদ” বলে অভিহিত করেন। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র এই ঘটনাকে “নাজি জার্মানির মতো” বলে তুলনা করেন। হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেন, “এই সরকার দুর্বলদের উপর শক্তি দেখায়, আর শক্তিশালীদের সামনে মাথা নোয়ায়।” কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য গুরগাঁওয়ে এসে বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ঘটনার নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “এ এক রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের নিদর্শন।”
কাঠোলা গ্রামের একটি পাড়ায় যেখানে আগে প্রায় ২০০০ জন অসমীয়া মুসলমান বাস করতেন, এখন সেটি প্রায় জনশূন্য। মাত্র কয়েকজন মহিলা অবশিষ্ট রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের স্বামী বা আত্মীয়দের খোঁজে ক্যাম্পে যেতে প্রস্তুত হচ্ছেন। অধিকাংশ মানুষ ইতিমধ্যেই অসমের ধুবড়ি বা পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গেছেন। ছাড়া পাওয়া শ্রমিকদের অনেকেই আর গুরগাঁওয়ে ফিরতে চাইছেন না। অসমের কোকরাঝাড় জেলার সাইরা বানোর পরিবার এখনো হতবাক। তিনি বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, কাজের জন্য এসেছিলাম। এখন আবার ফিরে যাচ্ছি। কবে আবার ফিরতে পারব জানি না। জীবিকা তো গুরগাঁওতেই।”
এই ঘটনাগুলি কেন্দ্র সরকারের নাগরিকত্ব ও অভিবাসন নীতির বাস্তব রূপকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের “চওড়া জাল ফেলে ধরপাকড়” কেবল সংবিধানবিরোধী নয়, বরং সমাজে গভীর বিভাজনও সৃষ্টি করছে। মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে এই ধরনের দমন-পীড়ন ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক সঙ্কেত বলে মনে করছেন অনেকেই।
