আজকাল ওয়েবডেস্ক: দিল্লির বাওয়ানা, গাজিয়াবাদের লোনি সহ একাধিক শহুরে বসতিতে গত কয়েক মাস ধরে ঘটে চলেছে এক উদ্বেগজনক ও মানবাধিকারের পরিপন্থী ঘটনা। বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসন শুরু করেছে নির্বিচার পরিচয় যাচাই, হেনস্তা, আটক এবং ‘হোল্ডিং সেন্টার’-এ পাঠানোর মতো দমনমূলক অভিযান। বাওয়ানার জে. জে. কলোনির বাসিন্দা ৫৪ বছরের সাজন বলছেন, “মন্দিরে গেলে যেমন প্রসাদ দিতে হয়, আমাদের পুলিশ স্টেশনে গেলেই দিতে হয় ঘুষ, আর না দিলেই মারধর।” দিল্লি পুলিশ সন্দেহ করছে, বাংলাভাষী মুসলিমরা বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে এসেছে। অথচ সাজন ও তাঁর মতো বহু পরিবার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে কাজের সন্ধানে দিল্লিতে এসেছিলেন বহু দশক আগে।
শবনম নামে ২৮ বছরের এক মহিলা জানিয়েছেন, তাঁর পরিবার গত ১৫ বছর ধরে দিল্লিতে বসবাস করছে। পরিবারের সদস্যদের আধার, ভোটার আইডি, রেশন কার্ড এমনকি জমির দলিল থাকলেও পুলিশ তাঁদের সন্দেহভাজন ‘বাংলাদেশি’ বলেই চিহ্নিত করছে। ৫ জুলাই পুলিশ তাঁদের বাড়িতে আসে এবং তাঁর বাবাকে থানায় ডেকে নিয়ে ঘুষ দাবি করে। ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় পুলিশ তাঁর ভাইদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়, রাতে বাড়িতে এসে মায়ের মুখে টর্চ মারার মতো ভীতিজনক আচরণ করে। ৮০ বছরের মহম্মদ জাফর বলেন, “আমি জমির দলিল দেখালাম, আধার কার্ড দেখালাম। তবুও পুলিশ বলল, ‘এগুলো টাকা দিলেই বানানো যায়’। এরপর সরাসরি হুমকি দেয়, বলে ‘তোমাকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবো, পাকিস্তান পাঠিয়ে দেবো’। আমার ধর্ম ও ভাষার জন্যই আমি এখন ‘অপরাধী’ হয়ে গেছি।”
আরও পড়ুন: নরেন্দ্র মোদীর নতুন ইতিহাস: টানা দ্বিতীয় সর্বাধিক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে
বাম নেত্রী বৃন্দা কারাত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে এই হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, “এটা শুধু দিল্লিতে নয়, গোটা দেশে ঘটছে। পুলিশ জানে অমিত শাহের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। তাই তারা যত বেশি নিপীড়ন চালাবে, তত বেশি তারকা জুটবে তাদের কাঁধে।” গাজিয়াবাদের লোনিতে আমজাদ হুসেন ও তাঁর পরিবারও এই অভিযানের শিকার। তাঁরা বিহারের মধুবনী জেলার বাসিন্দা, গত ১৫ বছর ধরে লোনিতে বাস করছেন। ৯ জুলাই সকালে দিল্লি পুলিশ তাঁদের বাড়িতে এসে 'তদন্ত' এর নামে ছয়জনকে ধরে নিয়ে যায়, যার মধ্যে রয়েছে দুটি শিশু। পরিবার আধার, প্যান, ভোটার কার্ড, স্কুল মার্কশিট, বিএ পাশের সার্টিফিকেট পর্যন্ত দেখিয়েছে। তবুও পুলিশ শুধু বলেছে, “তোমরা বাংলাদেশি, এখানে থাকতে পারো না।”
এই পরিবার এখন সারা রোহিলার হোল্ডিং সেন্টারে বন্দি। আইনজীবী আদিত্য আগরওয়াল জানিয়েছেন, ১৪ আগস্ট মামলার পরবর্তী শুনানি হবে। এই ঘটনা শুধু কয়েকটি পরিবার নয়, এক বৃহৎ সংখ্যক দরিদ্র, প্রান্তিক বাংলাভাষী মুসলমান শ্রমজীবী মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক হয়ে উঠছে। ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে নাগরিকদের ভারতীয় পরিচয়কে অস্বীকার করার এই নীতিকে অনেকেই বলছেন 'ধীরে ধীরে এনআরসি চালু করার পন্থা'। পুলিশের ভূমিকা শুধু পক্ষপাতদুষ্ট নয়, বরং তা এক গভীর রাজনৈতিক নির্দেশনার ফল বলেই মনে করছেন নাগরিক সমাজের অনেকে। শহর গড়ে তোলা শ্রমিকদের এখন নিজ শহরে থাকার অধিকারই ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে—আর তা হচ্ছে জাতীয়তাবাদের নামে, রাষ্ট্রের ছায়ায়।
