পরিচালক-অভিনেতা-গায়ক, তাঁর একাধিক সত্তা। ৭০ পেরিয়ে আজও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আলাদা করে দেখতে অভ্যস্ত অঞ্জন দত্ত। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নতুন করে তিনি তাঁর মনোজগৎকে জরিপ করেন। এবং সেসব বিষয়ে নিজের সোজাসাপটা বক্তব্য অবলীলায় বয়কট করে ফেলেন তিনি। আজও, বরাবরের মতোই! তাই তো অনুনকরণীয় ভঙ্গিতে সমাজমাধ্যমের পাতায় এক নাতিদীর্ঘ লেখা লিখেছেন, যা আদতে  অগ্নিগর্ভ, বেদনামাখা ব্যক্তিগত ম্যানিফেস্টো। যে লেখার প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে অঞ্জনের ভেতরের হতাশা, রাগ এবং অবশ্যই বাংলা ছবির প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা। যে লেখায় নিজের বন্ধুদের কটাক্ষ বললেও, আসলে এক গোটা প্রজন্মের স্মৃতিভ্রংশ আর সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বকেই আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন তিনি।

ফেসবুক পোস্টে অঞ্জন লিখেছেন, “সাধারণ দর্শককে নিয়ে আমি মোটেই ভাবিত নই, কিন্তু আমার বন্ধুরা—যাদের সঙ্গে এতটা সময় ভাগ করে নিয়েছি, যাদের সঙ্গে গান, সিনেমা, স্বপ্ন নিয়ে লড়েছি—আজ তাদের নিয়ে আমার গভীর সংশয়। তারা কি আদৌ সত্যিই বোঝে সত্যিকারের সিনেমা কাকে বলে? আমার এই বিষয়েও তীব্র সন্দেহ আছে যে তারা আমার অভিনয় অথবা গাওয়া গানও বোঝে কি না?  

আমার সাম্প্রতিক অভিনয় দেখে আজ তারা মেনে নিচ্ছে আমি একজন ‘চলনসই অভিনেতা’। অথচ তাঁরা ভুলে গিয়েছে আমরা কতটা মরিয়া হয়ে খুঁজেছি ও উদযাপন করেছি ভিন্নধারার কাজ। তারা মিশে গেছে আজকের প্রজন্মের ভিড়ে, যারা ‘বেলা বোস’ চেনে কিন্তু ফ্লয়েড বা ফেলিনিকে ভুলে গেছে।

 

 

এই বন্ধুদের সঙ্গেই একটা সময়ে আমি নিজের  জীবন ভাগ করে নিয়েছিলাম, করেছি স্বপ্ন ভাগ, একসঙ্গে বই পড়েছি, গান গেয়েছি । আর আজ তারা-ই দেখে না মায়ার জঞ্জাল বা মায়ানগর—বরং ভিড় করে খারাপ ছবি দেখতে, এবং তারপর অভিযোগ তোলে। ভেবে দেখুন—এই ছেলেমেয়েরাই তো ছিল আমার বন্ধু। নিজেদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলে দাবি করত। তারাই তো আশির দশকে সিনেমা উৎসবে ছুটত, আর এই শতকের গোড়ায় সুমনের গান মুখে মুখে গাইত। আজ কী হল তাদের? কেন  তাহলে আজকের তরুণরা, যারা সত্যি কিছু ভাল কাজ করার চেষ্টা করছে, তাদের প্রশংসা পাবে এদের কাছ থেকে—এই ভগ্নস্মৃতি, বিভ্রান্ত প্রজন্মের কাছে—যারা বিশ্বাস করে বাংলায় যা তৈরি হয়েছে, সবই নষ্ট বা পচা?

আমার এই বন্ধুরাই বড় বড় করে সত্যজিৎ রায় বা মৃণালের কথা বলে, অথচ বলতে পারে না কেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ বা ‘পদাতিক’ কাল্ট। তারা হাসাহাসি করে, কিন্তু দর্শক হিসেবে নিজের দায়িত্ব নিতে চায় না।

হ্যাঁ, তারা আমার বন্ধু থাকবে। তবু বলব,  তারা এক অপচয়িত প্রজন্ম—যারা এত ভাল জিনিসের মধ্যে বড় হয়েও আজ কেবল খারাপের মধ্যেই ডুবে আছে।

এটা আমার কাজ নিয়ে অভিযোগ নয়। এটা এক প্রজন্মের স্মৃতিভ্রংশের আখ্যান।”

 

অঞ্জনের এই বক্তব্য কমবেশি সমর্থন পেয়েছে নেটপাড়ার একাংশের। অঞ্জনের পোস্টের বার্তা বাক্সে নজর কেড়েছে এক নেটিজেনের মন্তব্য – “আপনার অনেক সৃষ্টি আমি গভীরভাবে পছন্দ করেছি — গানগুলো বেশি, ছবি কম। গানগুলোর বারবার শোনার ক্ষমতা বেশি; কারণ সঙ্গীতের নিজস্ব এক অন্তর্নিহিত গুণ থাকে যা চলচ্চিত্রে নেই।

দেখুন, মানুষের ভুলে যাওয়ার রোগ বাড়ছে—তবু যে অমর কৃতিত্বগুলো আছে, সেগুলো অতৃপ্তিভাবে স্মরণীয় থাকে। আপনি যে মানুষগুলোর সঙ্গে জুড়ে ছিলেন, তারা কি সত্যি ভুলে গিয়েছে পথের পাঁচালী, ভুবন সোম, আকালের সন্ধ্যানে? নাকি তারা ভুলে গিয়েছে ‘স্টকার’, ‘মিরর’, ‘ইভান্স চাইল্ডহুড’? তারা কি ‘দ্য গডফাদার’ সিরিজ বা কিসেলোস্কি, জিরি মেনজেল, আলমোদোভার, ট্রুফো—এইসব বিশিষ্ট নির্মাতাদের কাজ ভুলে গেছে? না — তারা তা ভুলে যায়নি।কিছু চলচ্চিত্রের একধরনের “শেল্ফ লাইফ” নেই; সেগুলো সময়ের ওপর দিয়ে উঠে আসে, এমনভাবে যে সময়ও তাদের টিকিয়ে রাখতে পারে না — কারণ সেগুলো সময়কে ছাপিয়ে যায়। তাই দুশ্চিন্তা করবেন না। সৃষ্টি করতেই থাকুন...”

 

 

 

পাল্টা জবাবে ‘খারিজ’-এর নায়ক লিখলেন, “…এটুকু বলতেই হয়—আপনি যেসব মহান ছবির কথা বলেছেন, সেগুলোর সঙ্গে এখন আর অনেকে কোনও যোগসূত্র খুঁজে পায় না।এই লেখাটা মোটেই কোনও অভিযোগ নয়, আর আমার কাজ নিয়েও নয়। শুধু একটি কথাই আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই—এখানে এক ধরনের বার্ধক্যজনিত নিস্তেজতা পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে। সম্ভবত যারা শহর ছেড়ে চলে গেছেন, তারা অনেকটা ভালো আছেন; অন্তত এখনও জিরি মেনজেলের নাম মনে রেখেছেন। হ্যাঁ, কিছু বন্ধু এখনও দারুণ কাজ করার ক্ষমতা রাখেন—কিন্তু এই সর্বব্যাপী নিস্তেজতা আর রসবোধের অভাবের কারণে তারা কোনও উৎসাহ খুঁজে পান না।

তবু আশার আলো আছে। শেখর দাশ আবার ছবি বানাচ্ছেন—এটাই আমার কাছে উত্তেজিত হবার মতো যথেষ্ট কারণ।”

গান, অভিনয়, পরিচালনা—সবকিছু মিলিয়ে অঞ্জনের যাত্রা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর সাম্প্রতিক পোস্টে ফুটে উঠেছে যে, তিনি এখনও সাংস্কৃতিক প্রশ্নে আপসহীন, এবং বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।

 

 

 

প্রসঙ্গত, ‘ওপেন থিয়েটার’ নামক নাটকের দলে কাজ করার পাশাপাশি সিনেমার জগতেও আটের দশকে কাজ করা শুরু করেন অঞ্জন দত্ত। মৃণাল সেনের পরিচালনায় ‘চালচিত্র’-এ তাঁর অভিনয় রাতারাতি তাঁকে দেশে-বিদেশে পরিচিত করে তোলে। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রথম গানের জগতে আসেন অঞ্জন দত্ত। প্রথম অ্যালবামের নাম ‘শুনতে কি চাও’। পরিচালনার পথে হেঁটেও বিস্তর প্রশংসা কুড়িয়েছেন অঞ্জন। ‘দ্য বং কানেকশন’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’, ‘চলো…লেট’স গো’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’, ‘শেষ বলে কিছু নেই’, সহ ব্যোমকেশ সিরিজের বেশ কিছু সিনেমা পরিচালনা করেছেন। ব্যোমকেশের সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য বর্তমানে ছিন্ন করেছেন অঞ্জন। তাঁর গান, তাঁর অভিনয়ে আজও মুগ্ধ আপামর বাঙালি। অঞ্জন-যাত্রা এইভাবেই অটুট থাকুক।