কৃশানু মজুমদার: ডার্বি ম্যাচ প্রতিষ্ঠা দেয়। আবার ডার্বি ম্যাচ 'অভিশাপ' হয়ে ধরা দেয়। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক তিনি সবথেকে ভাল বোঝেন। তিনি অমূল্য মণ্ডল।
সুনীল গাঙ্গুলি লিখেছিলেন, কেউ কথা রাখেনি। কেউ মনেও রাখেনি। অমূল্য মণ্ডলকে কেউ কি মনে রেখেছেন? বাঙালির বড় আবেগের ডার্বি ম্যাচে নেমেছিলেন। পনেরো মিনিট মাঠে ছিলেন। সেই প্রথম ডার্বি। সেই শেষ।
ভারতীয় ফুটবলে 'অমূল্য' সম্পদ হতে পারতেন। কিন্তু এখন তিনি মার্কেজের সেই কর্নেল। যাঁকে আজ আর কেউ চিঠি লেখে না। তিনি নিজেও নো নেটওয়ার্ক জোনের বাসিন্দা। তাঁর সমসামিয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন।
১৮ বছর আগের এক ডার্বি এতটা নিষ্ঠুর হয়ে ধরা দেবে, তা কি কেউ ভেবেছিলেন? অমূল্য এখন প্রাক্তন ফুটবলার। পিছন ফিরে তাকিয়ে তিনি বলছেন, ''বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য) আমাকে ধরমজিৎকে ম্যান মার্কিং করতে বলেছিলেন সেই ডার্বিতে। আমি সেই চেষ্টাই করছিলাম। কিন্তু প্রথম গোলটা হওয়ার পরে কোচ ফর্মেশন বদলে দিলেন। আমরা ৪-৫-১ ফর্মেশনে শুরু করেছিলাম। গোল হয়ে যাওয়ার পরে একটা হাফকে বসিয়ে একজন স্ট্রাইকার বাড়ান বাবলুদা। ৪-৪-২-এ চলে গিয়েছিলাম আমরা। আমাকে বসিয়ে দীপুদাকে (দীপেন্দু বিশ্বাস) নামানো হয়।''
আরও পড়ুন: জোতাকে স্মরণ করে ইপিএল অভিযান শুরু করল লিভারপুল, প্রথম ম্যাচেই সঙ্গী হল বিতর্কও
মোহনবাগানের 'ঘরের ছেলে' বলে পরিচিত সুব্রত ভট্টাচার্যকে কোচ করে এনে চমক দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ২০০৭-এর কলকাতা লিগের ওই ডার্বি দেখেছিল সাত-সাতটা গোল। মোহনবাগান ৪-৩ গোলে হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে।

প্রথমার্ধে লাল-হলুদ রক্ষণে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিল মোহনবাগানের আক্রমণ। বিরতির আগেই সবুজ-মেরুন ম্যাচ পকেটস্থ করে নেয়। দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গল কামব্যাকের চেষ্টা করলেও দিনান্তে শেষ হাসি তোলা ছিল মোহনবাগানের জন্যই।
অমূল্যকে অনভ্যস্ত পজিশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। তার উপরে আগের ম্যাচগুলোতেও তাঁকে প্রথম একাদশে রাখেননি সুব্রত ভট্টাচার্য। মোহনবাগানের প্রাণভোমরা হোসে রামিরেজ ব্যারেটোর পিছনে লাগানো হয়েছিল মাধব দাসকে। সেই কৌশলও কাজে আসেনি।
ডার্বির ওই ১৫ মিনিট অমূল্যর ফুটবলজীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। ইস্টবেঙ্গল হার হজম করায় তাঁর দিকেই উড়ে এসেছিল যাবতীয় সমালোচনা। ময়দান বড় কঠিন জায়গা। চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ে বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন সেদিনের তরুণ ফুটবলার। প্র্যাকটিসের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কোনওরকমে ইস্টবেঙ্গল-অধ্যায় শেষ করে চলে গিয়েছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ায়।
অমূল্য সেই প্রসঙ্গ উত্থাপ্পন করে বলছেন, ''আমি স্টপারের খেলোয়াড় ছিলাম। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে আমাকে কোনওদিন স্টপারে খেলায়নি। কখনও সাইড ব্যাক, কখনও হাফ। আমার পজিশনে খেলালে আমি ভাল খেলতাম। আমাকে মনে রাখত অনেকে। ডার্বিতে মাধব দাসকে স্টপারে খেলানো হয়। হয়তো বড় সড় চেহারার জন্য মাধব দাসকে স্টপারে নামানো হয়েছিল।''

ঠিক পজিশনে ব্যবহার না করায় ফুল ফোটার আগেই ঝরে যেতে হয়েছিল অমূল্য মণ্ডলকে। এখন কী করেন তিনি? কেউ খবর রাখেন? অমূল্য চলে গিয়েছেন অন্তরালে। বারুইপুরের ধপধপি নিবাসী প্রাক্তন ফুটবলার এখন ওষুধের কোম্পানির কর্মী। বাড়ির পাশের মাঠে সকাল থেকে বাচ্চাদের ফুটবলের অ-আ-ক-খ-এর পাঠ শেখান। তার পর অফিস। সারা দিনের পরিশ্রমের পরে বাড়ি ফিরে শিশুপুত্রর সঙ্গে খেলাধুলো করেই দিন কেটে যায়।
১৮ বছর আগের ইস্ট-মোহনের ম্যাচ এতটাই আঘাত হেনেছিল যে এখন আর ফুটবল দেখেন না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। রবিবার ডুরান্ড কাপের ডার্বি। সেই ম্যাচও তিনি দেখবেন না।
অমূল্য বলে চলেন, ''একসময়ে ফুটবল খেলতাম, ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি, জাতীয় দলে নইম স্যর ডেকেছিলেন, এগুলো আর বলতে ভাল লাগে না।''
কিন্তু কেন? অভিমান? দুঃখ? ব্যর্থতা? অমূল্য চুপ করে থাকেন। উত্তর দেন না।
ইউনাইটেড স্পোর্টসের জার্সি পিঠে চাপিয়ে শিল্ড ফাইনাল খেলেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে। ফাইনালে ওঠার পথে ইস্টবেঙ্গলকেও হারিয়েছিল ইউনাইটেড। সেখান থেকে বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি। ইস্টবেঙ্গল দলে নিয়েছিল অমূল্যকে। জাতীয় দলেও ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু চোটের অজুহাতে জাতীয় ক্যাম্পে আর যাননি।
প্রাক্তন ফুটবলার বলেন, ''ইউনাইটেডে খেলার সময় অলোক মুখোপাধ্যায় গোড়ার দিকে আমাকে স্টপারে খেলাতেন না। কিন্তু একটা ম্যাচে স্টপারে খেলানোর পর অলোকদা আমার পজিশন আর চেঞ্জ করেননি।''
দেড়-দু'বছর আগে পথ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন। একদা পিয়ারলেসের 'ঘরের ছেলে' বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালির এক বড় ম্যাচ তাঁকে যে ধাক্কা দিয়েছে,তার পর আর উৎসাহ পান না। বরং ভবিষ্যতের প্রজন্ম তৈরির কাজে তিনি নিজেকে মেলে দেন। অনুজ ফুটবলারকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে উৎসাহ দেন। প্রাক্তন ফুটবলার বলছিলেন, ''মোহনবাগানের যুব দলের গোলকিপার দ্বিপ্রভাত ঘোষ আমার বাড়ির কাছেই থাকে। লিগের একটা ম্যাচে ওর গোল হজম করা দেখে বলেছিলাম, আমার জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যাও।''

ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার জার্সিতে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন চার্চিল ব্রাদার্সকে রুখে দিয়েছিলেন অমূল্য। স্টপার পজিশনে খেলে পেয়েছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কারও। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলেই পেলেন না নিজের পজিশন। একটা ডার্বির পনেরো মিনিটই শুরু। সেটাই শেষ হয়ে থাকল।
ইস্ট-মোহনের লড়াইয়ের শেষ বাঁশির পর দুই দলের কংক্রিটের ভূখণ্ডে ভেসে ওঠে বিভিন্ন ছবি। কেউ হাসছেন। কেউ কাঁদছেন। হর্ষ-বিষাদ এক হয়ে যায়। চির আবেগের বড় ম্যাচ রেখে যায় 'অমূল্য-স্মৃতি'-ও। স্বপ্নহারানো, দিগভ্রষ্ট এক ফুটবলার এখন বলতেই পারেন, ''চেনো কি আমায়?''
আরও পড়ুন: সুনীল বাদ, নেশনস কাপের জন্য কোচ খালিদের ভারতীয় দলে মোহনবাগানের সাত ফুটবলার, লাল হলুদের তিন...
