কৃশানু মজুমদার: ২০০৭, ১৭ আগস্ট।
২০২৫, ১৭ আগস্ট।

দুই ভিন্ন সময়। ভিন্ন প্রেক্ষিত। মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে আঠেরোটা বসন্ত। বাঙালির চিরআবেগের ডার্বি মিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে অতীত ও বর্তমানকে।

ইস্ট-মোহনের লড়াই যেন আবেগের ফুটন্ত কড়াই। ১৮ বছর আগেও যা ছিল। এখনও তাই। স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ এতটুকু বদলায়নি। ১৮ বছর আগে এই যুবভারতীতে মোহনবাগান ৪-৩ গোলে হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। সেই ডার্বি বাঙালি এখনও ভোলেনি। এখনও চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলে মোহন-ইস্টের টক্কর। 

মোহনবাগানের গোল আগলানোর দায়িত্বে থাকা শিল্টন পাল এখনও হয়ে পড়েন নস্ট্যালজিক। স্মৃতি কড়া নেড়ে যায় প্রাক্তন ফুটবলারের মনে। ফুটবলার থেকে এখন মোহনবাগানের যুব ফুটবল সচিব হওয়া শিল্টনের মনে হয়, ''একটু বদলায়নি ডার্বি। সেই আবেগ, উদ্দীপনা, টেনশন রয়ে গিয়েছে আগের মতোই। রয়েছে টিকিটের হাহাকার। সবই তো আগের মতোই। কেবল বদলে গিয়েছে সময়টা। মাঝে চলে গিয়েছে অনেকগুলো বছর।'' 

আরও পড়ুন: 'দলে জায়গা হয়ই না,' রোহিতকে নিয়ে বিস্ফোরক পাঠান

১৮ বছর সাবালকত্বের বয়স। এই আঠেরো বছরে ডার্বি হয়ে উঠেছে আরও সাবালক। গুগল সার্চ ইঞ্জিনে ২০০৭, ১৭ আগস্ট লিখলে খণ্ড খণ্ড ছবি ফুটে ওঠে যুবভারতীর সেই বিখ্যাত বড় ম্যাচের। যেই ছবিগুলোর মালা গাঁথতে বসলে ভেসে ওঠে সেদিনের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ। 

লালম পুইয়ার গোল। মোহনবাগানের প্রাণভোমরা হোসে রামিরেজ ব্যারেটোকে 'মাধব-মার্কিং'। 'সবুজ তোতা'কে বশ করার দায়িত্ব সেদিন পড়েছিল লাল-হলুদের মাধব দাসের উপরে। প্রথমার্ধে মোহনবাগানের ব্যাপক আধিপত্য ছিল। সুনামির মতো আছড়ে পড়ছিল একের পর এক আক্রমণ। প্রথমার্ধেই ম্যাচ চলে গিয়েছিল সবুজ-মেরুন সাজঘরে। দ্বিতীয়ার্ধে আবার অ্যালভিটো ডি কুনহা ইস্টবেঙ্গলকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনেন। শেষমেশ জেতে মোহনবাগান। বাতাসে ওড়ে সবুজ-মেরুন আবির। 

Goalkeeper Shilton Paul joins Churchill Brothers

ওই বড় ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের রিমোট কন্ট্রোল হাতে ছিল মোহনবাগানের 'ঘরের ছেলে' বলে পরিচিত সুব্রত ভট্টাচার্যের হাতে। ম্যাচ হয়ে যাওয়ার বহু বছর পরেও তাই চর্চায় রয়ে গিয়েছে সেদিনের ডার্বি। 

টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে শিল্টন ফিরে যান পুরনো দিনে। তিনি বলেন, ''গত পরশু ওই ম্যাচটার কথা আমাকে বললেন একজন। যে কোনও ডার্বি বাঙালিদের কাছে রোমাঞ্চকর। আমি সেই সময়ে প্লেয়ার ছিলাম। এখন মোহবাগান অফিসিয়াল। ডুরান্ড কাপের এরকম একটা উত্তজেক ম্যাচ রবিবার। কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল জেতায় লাল-হলুদ সমর্থকরা আশার একটা আলো দেখতে পাচ্ছেন। গত কয়েকবছরে মোহনবাগানের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। ডার্বি হলে মোহনবাগানই জিতবে, এটাই হয়ে গিয়েছে নিয়ম। এবার হয়তো ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা মনে করছেন, আমরা পারলেও পারতে পারি। মনে রাখতে হবে মোহনবাগানের যা শক্তি, তাতে যে কোনও দলকে যে কোনও দিন হারানোর ক্ষমতা ধরে।''

রবিবার বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ার সেই ম্যাচ। কেমন হবে লড়াই? বহু যুদ্ধের সৈনিক শিল্টন বলছেন, ''এই ম্যাচ সবসময়ে কঠিন। পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। নির্দিষ্ট দিন যে দল ভাল খেলবে সেই দলই জিতবে। নার্ভ যার, বড় ম্যাচও তার। কলকাতা ডার্বিতে মোহনবাগান যুব দল নামিয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল সেই ম্যাচ জিতেছিল। কিন্তু ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে দুই দলই শক্তিশালী দল নামাবে। বিদেশি ফুটবলাররা এসে গিয়েছে মোহনবাগানে। দল আগের থেকেও শক্তিশালী। আমাদের ভারতীয় ফুটবলাররা যে কোনও সময়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ওরা একাই একশো।'' ডার্বির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে দুই দল। শেষ মুহূর্তে তুলির টান দেওয়ার কাজ চলছে দুই শিবিরে।

Shilton Paul

মরশুমের দ্বিতীয় ডার্বি হতে চলেছে রবিবারের মহাম্যাচ। এত আগে এই ধরনের বারুদে ঠাসা ম্যাচ পড়লে আদৌ কি খেলা ভাল হয়? ফুটবলজীবনের বিশাল অভিজ্ঞতা থেকে শিল্টনের ব্যাখ্যা, ''আমাদের সময়েও এরকম ঘটনা ঘটেছে। সিজন শুরু করেছি। দু-তিনটে ম্যাচের পরই চলে এসেছে ডার্বি। এখনকার খেলোয়াড়রা অনেক বেশি পেশাদার। ওরা জানে নিজেদের কীভাবে তৈরি করতে হয় নিজেদের।''

হোসে মোলিনা পেপ টক দিচ্ছেন তাঁর ছেলেদের। অন্যদিকে অস্কার ব্রুজোঁও ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। শিল্টন ফিরে যাচ্ছেন নিজের সময়ে। স্মৃতির পাতা উল্টে বলছেন, ''একেকজন খেলোয়াড়ের কাছে ডার্বি একেক ভাবে ধরা দেয়। এক সপ্তাহ আগে থেকে ডার্বির প্রস্তুতি শুরু করে দিতাম আমি। মোহনবাগান মাঠ ভর্তি থাকত সমর্থকে। বাইরের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিতাম। শরীর ঠিক রাখতে হবে। ডার্বির আগে নিজেকেও আলাদা করে নিতাম সবার থেকে। বড় ম্যাচের আগে বাড়িতে কেউই আসত না। ডার্বির জন্য মনোনিবেশ করতাম। ডার্বির দিন একা একা মাঠে যেতে পছন্দ করতাম। কিছু সংস্কার ছিল। যে ম্যাচে ভাল খেলেছি, সেই ম্যাচের গ্লাভস পরে খেলতে নামতাম।''

File photo: Shilton Paul (left) makes a save during an I-League game

ডার্বি মানে অনেক গল্প। অনেক অকথিত ছবি। যে ছবিগুলো চিরদিনের ফ্রেমে জায়গা করে নেয়। নিজের প্রথম ও শেষ ডার্বির কথা এখনও স্মৃতিতে টাটকা শিল্টনের। ফুটবলপাগলদের মনে পড়ে যায়, যুবভারতীর ওই দূরপ্রান্তের গোলপোস্ট থেকে দৌড়তে দৌড়তে শিল্টন কোলে উঠে পড়েছেন বর্তমান ক্লাবসচিব সৃঞ্জয় বোসের কোলে।

'বাগানের বাজপাখি' বলে সমাদৃত শিল্টন বলেন, ''ডার্বিতে তুল্যমূল্য লড়াই দেখতেই সবাই পছন্দ করেন। একতরফা ভাবে কোনও দলে জিতে গেলে ডার্বির আর মাহাত্ম্য কী! এখনকার সব খেলোয়াড়রাই বড় ম্যাচের গুরুত্ব বোঝে। কিন্তু বাঙালি ফুটবলারদের কাছে এই ম্যাচের গুরুত্ব অনেক বেশি। লিস্টনের থেকে শুভাশিস এই ম্যাচের পালস বেশি বুঝবে।''

কথায় বলে, পুজোর আগে আবহাওয়া বদলাতে শুরু করে। নীল আকাশ, শরতের মেঘ জানান দিয়ে যায় পুজো আসছে। বাঙালির 'ডার্বি উৎসব'-এর আগেও বদলাতে শুরু করে আকাশবাতাস। ম্যাচের দিন এই বাংলার সব রাজপথ এসে মিশে যায় যুবভারতীতে। টেনশন-আবেগ মিলেমিশে একাকার। 

 

?utm_source=ig_embed&utm_campaign=loading" data-instgrm-version="14"> ?utm_source=ig_embed&utm_campaign=loading" target="_blank" rel="noopener">
 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

?utm_source=ig_embed&utm_campaign=loading" target="_blank" rel="noopener">A post shared by Shilton Paul (@shiltonpaul)