আজকাল ওয়েবডেস্ক: মুম্বাইয়ের আর্থিক ক্ষেত্রে যখন সেকেন্ডে সেকেন্ডে কোটিপতি তৈরি হচ্ছে, তখনই দিনের আলোয় ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা। এটি কোনও গভীর রাতে সংঘটিত চুরি নয়, বরং দিনের পর দিন প্রকাশ্যেই চালানো হয়েছে এই ‘নিয়ন্ত্রিত জুয়া’। মূল ভূমিকায় বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জেন স্ট্রিট এবং তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে সবকিছু—ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেবির (SEBI) মৌন সম্মতিতে। ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১.২ কোটির বেশি খুচরো বিনিয়োগকারী ফিউচার ও অপশন (F&O) বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের কাছে এটি ছিল সহজেই ধনী হওয়ার ‘গেম’, যার প্রচার চালিয়েছে অ্যাপ, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার এবং ব্রোকারেজ হাউস। কিন্তু বাস্তবে, ৯৩% খুচরো বিনিয়োগকারী তাদের সঞ্চয় হারিয়েছেন—মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠছে—এই টাকাগুলি গেল কোথায়?
উত্তর সহজ: আন্তর্জাতিক হেজ ফান্ড ও ইনস্টিটিউশনাল ট্রেডারদের পকেটে, বিশেষত জেন স্ট্রিটের মতো ফার্মদের কাছে। এই মার্কিন সংস্থা, যাদের ভারতের বাজারে প্রায় কোনও দৃশ্যমান উপস্থিতি নেই, তারাই সপ্তাহের গুরুত্বপূর্ণ এক্সপায়ারি দিনে ভারতের ডেরিভেটিভস মার্কেটের ২৮% দখলে রেখেছিল। তারা একটি সহজ কিন্তু ভয়ঙ্কর কৌশল অবলম্বন করত—প্রথমে ব্যাংক নিফটি-র শেয়ারগুলো কিনে ইনডেক্স বাড়িয়ে দেওয়া, তারপর ডেরিভেটিভ মার্কেটে পতনের পক্ষে বাজি ধরা, এবং এক্সপায়ারির আগে শেয়ারগুলো হঠাৎ বিক্রি করে বাজার নামিয়ে দেওয়া। একেই বলে “marking the close”—এই ধরনের কৌশল আমেরিকায় অবৈধ। অথচ ভারতে এটা দিনের পর দিন ঘটেছে।
আরও পড়ুন: SEBI'র বিশ্বাসঘাতকতায় মুম্বাইয়ের আলো ঝলমলে শেয়ারবাজারে চলছে নীরবে লুটপাট
জেন স্ট্রিট ভারতীয় ব্রোকারেজ JSI ইনভেস্টমেন্টস, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের মাধ্যমে হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেড করে প্রচুর মুনাফা করেছে। এই মুনাফা বিদেশে পাঠানো হয়েছে, কোনও রকম কর না দিয়ে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়, সেবির কাছে এসব বন্ধ করার সমস্ত উপায় ছিল। তবু তারা নীরব ছিল, যেন এক প্রকার প্রশ্রয় দিচ্ছিল এই লুটপাটকে। ভারতের মধ্যবিত্ত, যারা স্বপ্ন দেখেছিল শেয়ার বাজারের মাধ্যমে সমৃদ্ধির, তারা বুঝতেই পারেনি—এই খেলা শুরু থেকেই একতরফা ছিল, আর এই পরাজয়ের নেপথ্যে ছিল রাষ্ট্রের নীরব সম্মতি।
সেবি ও আদানি গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ে গত কয়েক বছরে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারমূল্য ফুলিয়ে তোলার অভিযোগ তোলার পর, সেবির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়। অভিযোগ ছিল, আদানির বিভিন্ন অফশোর শেল কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার বাজারে কৃত্রিমভাবে চাহিদা তৈরি করা হয়েছিল, যার ফলভোগ করে খুচরো বিনিয়োগকারীরা। এই পরিস্থিতিতে সেবির নির্লিপ্ততা ও তদন্তে বিলম্ব, প্রশ্ন তোলে সংস্থাটির নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতার ওপর। এছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি জানায় যে, সেবি আদানির বিরুদ্ধে আগেই তদন্ত শুরু করেছিল, কিন্তু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি। এতে অনেকেই মনে করেন, সেবি সম্ভবত সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায়নি। এর ফলে বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নিয়ন্ত্রকের নিরপেক্ষতা—দুটিই প্রশ্নের মুখে।
