আজকাল ওয়েবডেস্ক: চার দশক পরে আবার মহাকাশে ভারতের পদচিহ্ন। আর সেই ঐতিহাসিক যাত্রার অন্যতম নায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা রবিবার (১৩ জুলাই, ২০২৫) আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র (ISS) থেকে পৃথিবীতে ফেরার আগে এক আবেগঘন ভাষণে বললেন, “আজকের ভারতকে মহাকাশ থেকে দেখে মনে হয়, এ দেশ আগ্রাসী নয়, বরং আত্মবিশ্বাসী, নির্ভীক, স্বপ্নময়। কারণ এই দেশ আজ কেবলই উন্নয়নশীল নয়—এটা স্বপ্নপূরণের পথে চলেছে। আজও আমি গর্ব করে বলতে পারি, ‘আজকের ভারত এখনও সারে জাঁহাঁ সে আচ্ছা দিখতা হ্যায়।’”
শুক্লা বললেন, “আমার যাত্রা শেষের পথে, কিন্তু আমাদের সম্মিলিত মানব মহাকাশ মিশনের পথ এখনও দীর্ঘ। এটি কেবল প্রযুক্তির নয়, এটি আশা, ঐক্য ও মানবিকতা গঠনের এক বিশ্বব্যাপী প্রয়াস। আমি বলতে পারি, যদি আমরা সংকল্পে অটল থাকি, তাহলে তারাদের ছোঁয়াও আর অসম্ভব নয়।” Ax-4 মিশনের অধীনে ভারতীয় বায়ুসেনার অভিজ্ঞ পাইলট ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুক্লা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন স্পেসএক্স ড্রাগন যানটিতে চড়ে। তিনি ছিলেন এই মিশনের পাইলট, এবং প্রথম ভারতীয় যিনি ISS-এ পৌঁছান। উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৮৪ সালের পর এই প্রথম একজন ভারতীয় আবার মহাকাশে গেলেন। তবে প্রযুক্তির দিক থেকে, এই মিশন অতীতের তুলনায় অনেক অগ্রসর ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নির্মিত।
আড়াই সপ্তাহ ধরে মহাকাশ কেন্দ্রে অবস্থানের সময় শুক্লা এবং তাঁর তিন আন্তর্জাতিক সহকর্মী একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ‘আউটরিচ’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রস্তাবিত গবেষণার ভিত্তিতে তিনি বিভিন্ন মাইক্রোগ্র্যাভিটি এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, “এখানে আমরা শুধু বিজ্ঞানের কাজ করিনি। আমরা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখেছি মানুষ কী করতে পারে যখন তারা বিভাজনের বদলে ঐক্য বেছে নেয়। মহাকাশে একসাথে থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে এই বিশ্বাস দিয়েছে—যদি আমরা ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে একত্র হই, তাহলে সব অসম্ভবই সম্ভব।”
আরও পড়ুন: বিটকয়েন ছুঁলো নতুন মাত্রা, ট্রাম্পের প্রো-ক্রিপ্টো নীতিতে উল্লসিত বাজার
তিনি আরও বলেন, “এখানে থাকাকালীন আমরা যেমন বিজ্ঞানচর্চা করেছি, তেমনি সময় পেলে পৃথিবীর দিকে তাকিয়েছি। যেভাবে পৃথিবী এখান থেকে দেখা যায়, তা এক রকমের যাদু। আমাদের মিশনের তাৎপর্য বিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে—এটা মানবজাতির একত্রে এগোনোর বার্তা।” Ax-4 মিশন সোমবার (১৪ জুলাই) বিকেল ৪:৩৫ নাগাদ (IST) ISS-এর হারমনি মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ড্রাগন যানটি পৃথিবীর দিকে রওনা দেবে। স্পেসএক্স জানিয়েছে, এই যাত্রা প্রায় ২২.৫ ঘণ্টার হবে, এবং ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিকেল ৩টায় 'splashdown' হবে। এর আগে ড্রাগন যানটি একাধিক কক্ষপথ হ্রাসকারী কৌশল, ট্রাঙ্ক জেটিসন এবং বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশের মতো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে।
মহাকাশ থেকে ফিরে, শুভাংশু শুক্লাকে এক সপ্তাহের জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হবে, যেখানে তিনি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে দেহকে মানিয়ে নিতে বিশেষ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকবেন। এই রিহ্যাব প্রোগ্রাম মহাকাশ অভিযানের পরে শরীরের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঐতিহাসিক মিশন শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব। ৩১টি দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এই মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিজ্ঞান, কূটনীতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই মিশন এক আন্তর্জাতিক সংহতির নিদর্শন হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মহাকাশ থেকে শুভাংশুর কথোপকথন এবং ভারতের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর 'হ্যাম রেডিও'–এর মাধ্যমে সংযোগ গোটা দেশের আবেগকে এক সূত্রে বেঁধে দেয়। এই যাত্রার মধ্য দিয়ে ভারত আবার জানিয়ে দিল—সে কেবল পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রই নয়, সে এখন মহাকাশ অভিযানের এক বাস্তব ও সম্ভাবনাময় শক্তি।
ISS থেকে ফিরে আসা শুভাংশু শুক্লা, তাঁর অভিজ্ঞতা ও বার্তার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে শুধু অনুপ্রাণিত করলেন না, বরং গোটা জাতিকে মনে করিয়ে দিলেন—“তারাও ছোঁয়া যায়, যদি আমরা একসাথে চলি।” স্পেসএক্সের ড্রাগন মহাকাশযান, যাতে শুভাংশু শুক্লা ছাড়াও রয়েছেন মিশনের কমান্ডার ও অভিজ্ঞ মার্কিন নভোচারী পেগি হুইটসন, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ESA) পোলিশ নভোচারী স্লাভোস উজনান্স্কি-ভিসনিয়েভস্কি, এবং হাঙ্গেরির টিবর কাপু—সেটি সোমবার ভারতীয় সময় বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ISS থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা। প্রায় ২২ ঘণ্টার যাত্রার পর, মঙ্গলবার ভারতীয় সময় বিকেল ৩টার দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরে এই যানটির 'splashdown' হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে Ax-4 মিশনের বিদায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নাসার এক্সপেডিশন ৭৩-এর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা বলেন, “এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে একপ্রকার জাদুর মতো মনে হয়েছে... আমার জন্য এটি এক অসাধারণ যাত্রা ছিল।”
