গোপাল সাহা

আবহাওয়া দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে বৃষ্টির প্রকোপ আরও কিছুদিন থাকবে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নানা রকম রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে। যা নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ একই সঙ্গে চিকিৎসকরাও। মরসুমের এই সময় বহু জীবাণু সচল হয়ে ওঠে। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম হওয়ার সহজেই রোগের কোপে পড়তে হয়।

এই ধরনের স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভাইরাল ফিভার, বিভিন্ন রকম পেটের রোগ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়াও কলেরা বা টাইফয়েডের মত ভয়াবহ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট পরিমাণ বেড়ে যায়। উল্লেখ্য, মাত্র কয়েকদিন আগেই কলকাতায় এক কলেরা আক্রান্তের মৃত্যুর কারণে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন কলকাতা কর্পোরেশন এবং রাজ্য সরকার। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি সহযোগিতায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমলেও ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। কারণ, মানুষের মধ্যে সচেতনতা এখনও অভাব রয়েছে। এ জায়গায় সমাজের সচেতনতা অধিক মাত্রায় প্রয়োজন সরকারি তৎপরতার পাশাপাশি।

চিকিৎসকদের মতে, এই প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে জলবাহিত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অধিক মাত্রায় থাকে, তাই সেদিকে বেশি করে নজর দিতে হবে। 

* স্ক্রাব টাইফাস রোগের কথা গ্রাম বাংলায় প্রায়ই শোনা যায়। মাঠে-ঘাটে বড় বড় ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে টিক্স নামে এক ধরনের পোকা। যা কামড়ালে এই রোগটি হয়। 

* লেপ্টোস্পাইরোসিস ইঁদুরের প্রস্রাব থেকে হয়ে থাকে। গ্রামে মাঠেঘাটে বাচ্চারা খেলতে গেলে সেখানে ইঁদুরের প্রস্রাব থাকলে তা শরীরে সংস্পর্শে আসলেই এই ধরনের রোগ হয়। যা পরবর্তীতে মারণ রোগে পরিণত হতে পারে। এর থেকে জন্ডিস বা কিডনি পর্যন্ত নষ্ট হতে পারে। এই রোগে উপসর্গ জ্বর দিয়েই শুরু হয়। এমনটাই জানাচ্ছেন চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা।

* এছাড়াও নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা সহ একাধিক জীবাণু বাহিত রোগ। প্রাকৃতিক আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে দুটো পরিবর্তন প্রধানত লক্ষণীয় উষ্ণতা ও আদ্রতা। এর সাথে সাথে মানবদেহেও এই দুটো জিনিস শরীরের মধ্যে চেঞ্জ হয়, যা কৃত্রিমভাবে পরিবর্তন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ভয়ের কারণ বেশি যাদের আন্ডারলাইন কোমরভিডিটি রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে বেশি করে সচেতনতার প্রয়োজন। 

* বয়স্ক লোকেদের ক্ষেত্রে সিওপিডি, অ্যাজমা, অথবা হৃদয় জনিত রোগ, যা মারন রোগেও পরিণত হতে পারে। যার জন্য অধিক মাত্রায় এই সময় সচেতন থাকা জরুরী। 

* এই সময় চর্মজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যায়। কারণ আদ্রতা থাকার কারণে ত্বকের জল শুকায় না। ফলে হাজা, দাদ, চুলকুনি, মূলত ছত্রাক জনিত রোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। যারা জলে কাজ করছেন তাদের জন্য সচেতন থাকা খুব জরুরী। 

চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে এই পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকার জন্য যেসব বিষয় মেনে চলা জরুরি। 

• পুষ্টিকর খাবার যেমন- শাকসবজি, ফল, বাদাম, মাছের তেল ইত্যাদি। পরিষ্কার জল পান করুন। সম্ভব হলে শিশুদের ফুটনো জল দিন।

• রাস্তার কাটা ফল বা খোলা খাবার এড়িয়ে চলুন। হাত ভালভাবে পরিষ্কার রাখুন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।

• সঠিক সময়ে এবং পরিমাণমতো ঘুমান। কর্মক্ষেত্রে বা দৈনন্দিন জীবনে অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপ নেবেন না। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম বা ধ্যান করুন।

• বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন। খোলা পাত্রে জল জমতে দেবেন না। জলের ট্যাংক ও চৌবাচ্চা নিয়মিত পরিষ্কার করুন।

• ঘুমানোর সময় মশারি টানান। শিশুদের মশার কামড় থেকে বাঁচাতে মশা তাড়ানোর উপকরণ (mosquito repellents) ব্যবহার করুন। বর্ষাকালে শিশুদের জলাবদ্ধ স্থান বা জঙ্গলে যেতে দেওয়া থেকে বিরত রাখুন।

• বাড়ির শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের সময়মতো টিকা দিন—ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ অনুযায়ী। শারীরিক সমস্যা হলে নিজে থেকে ওষুধ না খেয়ে উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

• হাঁচি-কাশি হলে মাস্ক ব্যবহার করুন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকুন এবং নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অযথা কারো হাত ধরার অভ্যাস থেকে বিরত থাকুন।

• বিদ্যুতের তার বা খোলা বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে সাবধান থাকুন। প্রয়োজনে নিকটবর্তী বিদ্যুৎ অফিসে আগে থেকে খবর দিন। অতিরিক্ত বজ্রপাত বা ঝড়ের সময় বাইরে থাকবেন না।

এ বিষয়ে আজকাল ডট ইন-এর তরফ থেকে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়েছিল চিকিৎসক (ইমিউনোলজিস্ট) সঞ্জীব মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, "বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রত্যেকটি মানুষের দেহেরই একটি প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে বা জন্মের পর থেকে গড়ে ওঠে। তাকে আমরা কোনও ভাবেই পরিবর্তন করতে পারি না। কিন্তু তা ঠিক রাখার জন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করতেই পারি। এই পরিস্থিতিতে অবশ্যই আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এর মধ্যে জলবাহিত রোগ উল্লেখযোগ্য। যে কোনও ক্ষেত্রে মূলত বাথরুম করে আসা বা কোন কাজ করে অবশ্যই হাত ধোয়া, জলকে ফুটিয়ে খাওয়া বা পরিশোধিত জল ব্যবহার করা। এই বিষয়গুলি নজরে রাখতে হবে। বাইরের খাওয়া বর্জন করা মূলত শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় সবুজ শাকসবজি খাওয়াটা খুবই জরুরী। এছাড়াও বাদাম, ফিসি অয়েল খাওয়া দরকার এর ফলে  শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে।"

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ বলেন, "এই আবহাওয়ায় জলবাহিত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই অন্যদের থেকেও শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি করে নজর রাখতে হবে। অবশ্যই জল ফুটিয়ে খেতে হবে। কোনও কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় জল শোধিত না করে, ফুটিয়ে খাওয়া অনেক শ্রেয়। কারণ এই পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গি, কলেরা, হেপাটাইটিস বি, ভাইরাল ফিভার, ইনফ্লুয়েঞ্জা সহ নানা রকম রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই কোন রকম জ্বর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।“

চিকিৎসক তাপস প্রামানিকও এক্ষেত্রে জলের দিকে বেশি করে নজর দিতে বলেছেন। তিনি বলেন, "এ ধরনের প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে জলবাহিত রোগের পাশাপাশি পেটের রোগ ও মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই যে কোনও অবস্থাতেই শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে জল ফুটিয়ে খাওয়া অত্যাধিক জরুরি।  কোনও ভাবে বাড়ির আনাচেকানাচে জল জমা না হয়। কারণ, পরিষ্কার জলেই ডেঙ্গি মশার জন্ম হয় এবং এরা দিনের বেলায় কামড়ায়। প্রয়োজনে বারবার হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নইলে ছত্রাকজাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জ্বর হলে অবশ্যই সরাসরি চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।"