অস্ট্রেলিয়া-২১২ (প্রথম ইনিংস), ২০৭ (দ্বিতীয় ইনিংস)
দক্ষিণ আফ্রিকা- ১৩৮ (প্রথম ইনিংস), ২৮২-৫ (দ্বিতীয় ইনিংস)

৫ উইকেটে জয়ী দক্ষিণ আফ্রিকা।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: সার্চ ইঞ্জিনে 'চোকার্স' শব্দটা টাইপ করলে এতদিন ফুটে উঠত দক্ষিণ আফ্রিকা। শনিবার থেকে বদলে গেল তা। লর্ডসে 'চোকার্স' অপবাদ ঘোচাল তেম্বা বাভুমার প্রোটিয়া ব্রিগেড।  

কেপলার ওয়েসেলস, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, গ্যারি কার্স্টেন, শন পোলক, গ্রেম স্মিথ-সহ আরও অনেকে যে চূড়োয় পৌঁছতে পারেননি, তেম্বা বাভুমা সেই শিখরে পৌঁছে বিজয়কেতন ওড়ালেন নিজের, দক্ষিণ আফ্রিকার।  অনুপ্রেরণার আরেক নাম বোধহয় বাভুমা। অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে টেস্টের নতুন রাজা দক্ষিণ আফ্রিকা। 

শনিবার শেষ পর্যন্ত ক্রিজে থেকে দেশকে জেতাতে হয়তো পারলেন না প্রোটিয়া ক্যাপ্টেন বাভুমা, কিন্তু চোট নিয়ে তাঁর লড়াই প্রেরণা জুগিয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার সাজঘরে। হাঁটতে পারছেন না। খোঁড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে টাইমিং করতে সমস্যা হয় ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু হাল ছেড়ে মাঝপথে চলে যাননি বাভুমা। প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়ার সময়ে দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলেন। ধারাভাষ্যকার বললেন, ''অবিশ্বাস্য ইনিংস।''

৬৯ রান করলেই জয়। এই অবস্থায় মরণ কামড় দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কামিন্সের বলে ঠকে গেলেন বাভুমা। ৬৬ রানে শেষ হল তাঁর লড়াকু ইনিংস। 
স্টাবসের (৮) উইকেট ভাঙলেন স্টার্ক। ক্রিকেটভক্তদের হৃদয়ে চিরকাল জায়গা করে নেবে মার্করামের দুর্দান্ত ইনিংস। আর ছয় রান করলেই ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে নেবে দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্করাম ফিরলেন তখনই।

১৩৬ রানে শেষ হল তাঁর মহাকাব্যিক ইনিংস। শেষপর্যন্ত জিতিয়ে ফেরা হল না তাঁর। তাঁর দুই সতীর্থ বাকি কাজটা করেন। মার্করাম না থাকলে বাভুমার স্বপ্ন পূরণ হত কিনা সন্দেহ! ম্যাচের সেরাও মার্করাম। আর ছ'রান যখন দরকার, বাভুমা চুপ করে বসে আছেন লর্ডসের ব্যালকনিতে। তাঁর চোখ দুটো শান্ত। লর্ডসে বহু ইতিহাস তৈরি হয়েছে। আরও একবার নতুন এক ইতিহাস লেখা হল। চিরকালের ফ্রেমে জায়গা করে নিলেন বাভুমা। তাঁকে কে ভুলবে!  

কাট টু ২০১৬। নিউল্যান্ডসের এসএসি জুনিয়র স্কুলে বছরের প্রথম টার্মের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের জন্য একটা লেখা নিয়ে এলেন প্রধান শিক্ষক।  এই স্কুলের পুরোনো এক ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া লেখাটি। ২০০১ সালের গ্রেড সিক্সের শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল ১৫ বছর পর তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও, তা নিয়েই লেখো। 

একটি ছেলে লিখেছে, ''পনেরো বছর পর আমি নিজেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে দেখি, এ জন্য মিস্টার এমবেকির (দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট) সঙ্গে করমর্দন করছি।'' দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখা সেই ছেলেটার নাম তেম্বা বাভুমা। 

প্রধান শিক্ষক যখন শিশু-কিশোরদের ওই লেখাটা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন, তার চার-পাঁচ দিন আগে নিউল্যান্ডসের ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স ক্রিকেট ক্লাব মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০২ রানের ইনিংস খেলে ফেলেছেন বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে কোনও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানের টেস্ট শতক এটিই প্রথম।

বাভুমার স্বপ্নপূরণ আর ইতিহাস গড়ার গৌরব সে দিন এসএসি জুনিয়র স্কুলের ১০ থেকে ১১ বছর বয়সীদের জন্য হয়ে উঠেছিল বড় অনুপ্রেরণার। ২০২৫ সালের ১৪ জুনের পরে বাভুমা সব অর্থেই দেশের নায়ক। তাঁর ছোঁয়ায় চিরন্তন চোকার্স বদনামও ঘুচে গেল। 

চলতি বছরটা উপেক্ষিতদের ঘুরে দাঁড়াবার। যে স্বপ্ন, যে গল্পগুলো বারবার থেমে গিয়েছিল মাঝপথে,শেষপ্রান্তে বা প্রায় শেষে মুখ থুবড়ে পড়েছিল সম্ভাবনার নিষ্ফল প্রতীক্ষা নিয়ে, খেলার মাঠের সেই গল্পগুলোই এবার জেগে উঠেছে।  লিখেছে নতুন ইতিহাস। জয় ছিনিয়ে নিয়ে তারাই বলছে, ''আমরাও পারি। আমরাও এখন ইতিহাস।''

লর্ডসে বাভুমার দক্ষিণ আফ্রিকা তাই বলে গেল। এক উপেক্ষিত দেশ টেস্ট সেরার তাজ তুলল মাথায় এক উপেক্ষিত অধিনায়কের হাত ধরে। বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে এক চিরন্তন দুঃখের নাম। বাংরবার বড় টুর্নামেন্ট এসেছে আর আসল সময়ে রথের চাকা বসে গিয়েছে। ১৯৯৮ সালের মিনি বিশ্বকাপ জয় ছাড়া আর বলার মতো কী আছে দক্ষিণ আফ্রিকার শো কেসে। 

এই ২০২৫ সালে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিশাপ বুঝি কাটল। তেম্বা বাভুমাকে নিয়ে কত গল্প। তাঁর ছবি নিয়ে কালি খরচ হয়েছে প্রচুর। ক্যাপ্টেন সুলভ তিনি একেবারেই নন। তিনি খর্বকায়। তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই তিনিই আজ ট্রফি হাতে তুলে হাসছেন। এই হাসি অনেক কষ্ট ভোলার।  

কে ভুলতে পারবে বিশ্বকাপ শুরুর আগেরদিন ১০ অধিনায়ক নিয়ে ‘ক্যাপ্টেন্স ডে’ অনুষ্ঠানের কথা। ছবিটা ঘুমের। সঞ্চালকের দুই পাশে অধিনায়করা বসে রয়েছেন। একেক জন বলছেন, বাকিরা শুনছেন। 

বাংলাদেশের অধিনায়ক শাকিব আল হাসানের কাছে যখন মাইক, ছবিটা সেই সময়ের। বাঁ দিকে মাথা হালকা কাত করে রয়েছেন তেম্বা বাভুমা। চোখ দুটি বোজা। যে কেউ দেখলেই বলবেন বাভুমা ঘুমোচ্ছিলেন। 

বাভুমার ওই ঘুমের ছবিটা নিয়ে আলোচনা হয় তীব্র।  সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় হাসাহাসি। বাভুমা পরে জানিয়েছিলেন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন না। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের কারণে এমনটা মনে হয়েছে। এক ঘুমিয়ে পড়া অধিনায়কই ঘুম ভাঙাল দক্ষিণ আফ্রিকার। 

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খর্বকায় বাভুমার লড়াই-ই বা ভুলবেন কে? ইনিংস চলাকালীন রান নেওয়ার সময়ে চোট পেয়েছিলেন তিনি। সেই চোট নিয়েই লড়ে গেলেন। অবসৃত হলেন না। 

দক্ষিণ আফ্রিকায় কেউ কেউ তাঁকে 'কোটার ক্যাপ্টেন' বলেন। সেই 'কোটার ক্যাপ্টেন',  এক 'কৃষ্ণাঙ্গ' অধিনায়ক ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন এক গল্প লিখে গেলেন ক্রিকেটপৃথিবীতে।