কৃশানু মজুমদার: হিরের দর্পচূর্ণের অন্যতম নায়ক তিনি। সেই তিনিই আবার বলছেন, ''নক্ষত্ররাজির মাঝে আমি এক নগন্য ফুটবলার আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি'' কলকাতা ময়দানের প্রতিটি ঘাস জানে নাজিমুল-রূপকথা। তিনি নাজিমুল হক।

'ডায়মন্ড'-ম্যাচের প্রথম গোলদাতা। এটাই অবশ্য তাঁর এক ও একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি একাধারে ফুটবলার আবার ফুটবল-শিক্ষক। একইসঙ্গে সুন্দর ব্যক্তিত্ব গঠনের সহজ পাঠ দেন ছাত্রদের। মায়ের কাছ থেকে ছেলেবেলায় পাওয়া শিক্ষা এখনও তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি। মা-বাবা তাঁর আরাধ্য দেবতা। এই শিক্ষক দিবসে ছাত্রকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে বসেন, ''মা-বাবাকে প্রণাম করেছিলি?''

এহেন নাজিমুল আবার সচেতনতা বাড়ান পথচলতি মানুষদের। তিনি বলছেন, ''সেদিন দেখি অল্পবয়সী একটি ছেলে কলা খেয়ে খোসাটা রাস্তায় ফেলে দিল। আমি দেখেই সেই ছেলেটিকে বলে উঠলাম, খোসাটা রাস্তায় ফেললি! মানুষজন আসছে-যাচ্ছে। পা হড়কে পড়ে যেতে পারে। ছেলেটি নিজের ভুল বুঝতে পেরে কলার খোসা অন্যত্র ফেলে দিল''

আরও পড়ুন: প্রস্তুতি চরমে, কড়া অনুশীলনের মাঝেই মুখোমুখি ভারত এবং পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা, জানুন বিস্তারিত...

বারাসত-নিবাসী নাজিমুল হক এমনই। ফুটবল মাঠে তিনি রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনও দিন প্রতিবাদ করেননিফুটবলজীবনে একটি হলুদ কার্ডও তাঁকে দেখতে হয়নি। দুই দলের ঝামেলা রুখে দিয়েছেন। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে দাতগুলো প্রায় যায় যায় অবস্থা। অথচ কাউকে পালটা পা চালাননি। আজকের যুগে এমন কথা ভাবাই যায় না। রেফারির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পারলে প্রহৃত হন তাঁরা। কিন্তু নাজিমুল বলছেন অন্য কথা, ''রেফারি মাত্রই মানুষ। ভুল তাঁরও হতে পারে। তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা, অঙ্গভঙ্গি করা মানেই গ্যালারিতে আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। আগুনের ফুলকি ডেকে আনে সর্বনাশ'' তিন প্রধানের প্রাক্তনের জীবনবোধ মুগ্ধ করবেই। 

May be an image of 2 people and people smiling

১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল দেখেছিল ইস্ট-মোহনের বারুদে ঠাসা এক লড়াই। সেই ম্যাচ আর নাজিমুল হক এখন সমার্থক হয়ে গিয়েছেনম্যাচের আগেরদিন মোহনবাগানের কিংবদন্তি কোচ অমল দত্ত টীপ্পনি কেটে ভাইচুংকে 'চুমচুম', ওমোলোকে 'ওমলেট' বলেছিলেন। তেতে উঠেছিল পিকে ব্যানার্জির ইস্টবেঙ্গল

প্রথম কুড়ি মিনিটের মোহনবাগান ঝড়ে ইস্টবেঙ্গল রক্ষণে তখন 'ত্রাহি ত্রাহি' রব। কিছুক্ষণের মধ্যেই 'কহানি মে টুইস্ট'নাজিমুলের ভলিতে কেঁপে ওঠে মোহনবাগানের জাল। তার পরের ঘটনা ইতিহাস। ভাইচুং ছিঁড়ে ফেলেন মোহনবাগানের রক্ষণ। হ্যাটট্রিক করেছিলেন 'পাহাড়ি বিছে'। সেই বড় ম্যাচ এখনও বাঙালির রক্তের গতি বাড়িয়ে দেয়। নাজিমুলকেও যে করে তোলে নস্ট্যালজিকহিরের দর্পচূর্ণ হয়েছিল সেদিন।

May be an image of 1 person, playing football, playing soccer, grass and text

ডায়রির ছেঁড়া পাতা উল্টে তিনি বলছেন, ''অ্যাকাডেমির টিম নিয়ে বিলাসপুরে গিয়েছিলাম। সেই মাঠে আমি নিজে ১৯৯৩ সালে খেলেছিলাম বাটার হয়ে। গোলও ছিল। ধারাভাষ্যকাররা আমাকে দেখেই বলছিলেন, ১৯৯৭-এর সেই ডার্বি ফিফার বিচারে বিশ্বের তৃতীয় সেরা। সেই বড় ম্যাচের গোলদাতা নাজিমুল হক এখন কোচ। পুরনো কথা মনে পড়লে ভাল লাগে''

খালি পেটে খেলতে নেমে গোল করেছেন মোহনবাগান জার্সিতে। তিন প্রধানের জালে বল জড়িয়ে তিনিই আবার হয়ে উঠেছিলেন 'জায়ান্ট কিলার'। সেন্টার সার্কেলের কাছ থেকে দূরপাল্লার শটে জালও কাঁপিয়েছেন প্রতিপক্ষের।

স্মৃতির সরণী ধরে হেঁটে চলেছেন নাজিমুল, ''আমি তখন মোহনবাগানেশিল্ডের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি মোহনবাগান-মহমেডান স্পোর্টিং। সেদিনই আবার এজি বেঙ্গলের চাকরির ট্রায়াল দিতে গিয়েছি সেই কোন সকালে। খাওয়া-দাওয়া নেই। সবাই জানতেন, আমার চাকরি পাকা। কিন্তু আমি সেই অপেক্ষায় না থেকে ট্রায়াল দিতে চলে গিয়েছিলামএদিকে ট্রায়াল শেষ হতে দেরি হয়ে গিয়েছেদৌড়তে দৌড়তে আমি ড্রেসিং রুমে ঢুকলামটিম লিস্টে আমার নাম থাকবে না বলে ধরেই নিয়েছিলাম। দেখি পিকে ব্যানার্জি আমাকে প্রথম এগারোয় রেখেছেন। বকুনি অনিবার্য জেনে ড্রেস পরে চিমার পিছনে লুকিয়ে পড়েছিলাম''

তার পর কী হয়েছিল? নাজিমুল বলেন, ''প্রথমার্ধে আমি গোল করলাম। পেটে কিছু পড়েনি সকাল থেকে। বিরতির পরে কিছু খাওয়ার পর মনে হল জান ফিরে পেলাম। দ্বিতীয় হাফে আবার আমার গোল। চিমাকে দিয়ে তৃতীয় গোল করানো হল। ম্যাচটা আমরা ৩-০ গোলে জিতলাম। পাঁচ হাজার টাকার ম্যাচ সেরার পুরস্কারও পেলাম''

টুকরো টুকরো স্মৃতি দিয়ে মালা গেঁথে চলেন নাজিমুল। বলেন, ''পিকে স্যর সেদিন কেন আমার নাম কাটেননি জানেন? ইস্টবেঙ্গলে থাকার সময়ে আমি বাসেই যাতায়াত করতাম। একদিন অনুশীলনে যাওয়ার সময়ে বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ল। এক ঘণ্টা দেরিতে অনুশীলনে পৌঁছলাম। পিকে স্যর বললেন, তোকে অনুশীলন করতে হবে না। বসে থাক। আমি প্রায় দেড় ঘণ্টা বসে বসে প্র্যাকটিস দেখলাম। তার পরে একটা বল নিয়ে আমি একা একাই ঘণ্টাখানেক অনুশীলন শুরু করে দিই। এদিকে প্রদীপদা যে আমাকে আড়াল থেকে দেখছেন, আমি বুঝিনিচোখাচোখি হতেই প্রদীপদা চলে গেলেন তাঁবুর ভিতরে। আমার ভিতরে যে খিদে রয়েছে, সেটা পিকে স্যর বুঝতে পেরেছিলেন''

এই খিদে, এই ঘাম ঝরানো চেষ্টা তিনি শিখেছিলেন মায়ের কাছ থেকে। নাজিমুল বলছেন, ''মা আমার প্রথম গুরু। মা বলতেন, কাকের মতো প্রচেষ্টা, কুকুরের মতো সজাগ ঘুম এবং বকের মতো ধৈর্য যাঁর, সে জীবনে উন্নতি করে''

নাজিমুলও ব্য়বহারিক জীবনে সেই ব্রতে ব্রতীমায়ের দেখানো পথ ধরেই তিনি হাঁটার চেষ্টা করেন। ঘুরে ফিরে চলে আসে তাঁর ফুটবলজীবনের আখ্যান। শিল্ডের সেমিফাইনালে জেসিটির বিরুদ্ধে পিছিয়ে থাকা মোহনবাগানের হয়ে সমতা ফেরান নাজিমুলই। রঞ্জন চৌধুরী ২-১ করে যান সবুজ-মেরুনের হয়ে। তবুও শিল্ড ফাইনালে জায়গা হয়নি নাজিমুলের

আবার মোহনবাগান-মহমেডান ম্যাচে ব্যারেটোকে হ্যাটট্রিকেই জবাব দিয়েছিলেন নাজিমুলশেষমেশ সবুজ তোতার গোল্ডেন গোলে ম্যাচ জয় মোহনবাগানেরএত কিছুর পরেও কি আমরা মনে রাখলাম তাঁকে? নাজিমুল প্রতিবাদ করে ওঠেন, ''ফুটবল আমাকে অনেক দিয়েছে। তিন প্রধানের হয়ে ফুটবল না খেললে আজ কি আমাকে কেউ মনে রাখতেন? ভারতবর্ষের যে কোনও প্রান্তে ফুটবল নিয়ে আলোচনা হলে আমার কথা উঠবেই উঠবে। আমি যা পেয়েছি, অনেকেই তা পাননি''

এহেন প্রাক্তন ফুটবলারের কথায় অনেকের চাকরি হয়েছে। কিন্তু তাঁর নিজেরই জুটল না একটাও চাকরি। নাজিমুল বলছেন, ''আমার আক্ষেপ নেই। আবার আক্ষেপও রয়েছে। একটা যদি চাকরি পেতাম''

May be an image of 3 people, beard and people smiling

বুটজোড়া তুলে রেখেছেন সেই ২০১২ সালে। এখনও তিনি ফুটবল আঁকড়েই বাঁচেন। আগে ফুটবল মাঠে গোল করার জন্য যুদ্ধ করতেন ডিফেন্ডারদের সঙ্গে। এখন জীবনযুদ্ধে লড়ে চলেছেন একাই। এই লড়াই যে আরও কঠিন তা প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করেন। তিনি বলছেন, ''আপনাদের লেখা পড়ে রাজ্য সরকার যদি আমার কথা ভাবে...।'' কথা শেষ করেন না তিনি।

জীবনের এই লড়াইয়ে তিনি পাশে পেয়েছেন সহধর্মিনী পারভিন সুলতানাকেনাজিমুল বলছেন, ''আমরা একে অপরের এনার্জি। একজন পুরুষের পাশে তাঁর সহধর্মিনী থাকলে সেই পুরুষের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান বলেই মনে করি।''

মফস্বল থেকে আসা এক তরুণ স্বপ্ন দেখতে সে কলকাতা রাজত্ব করবে দীর্ঘদিন। কিন্তু বনস্পতির সন্ধান আর পেল কোথায় সে! যে বনস্পতির ফুল-ফল আর ছাউনি পেলে তাঁর স্বপ্নগুলো আকাশ ছুঁতে পারত, তা তো হল না। অনেক স্বপ্নই যে আকাশ ছোঁয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়

রবিঠাকুর তাঁকে দু'দণ্ডের শান্তি দিয়ে যান। তাঁর অমর সৃষ্টিতে জীবনকে খোঁজেন নাজিমুল। তিনি বলছেন, ''রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।'' 

তাঁর আশ্রয় নিয়ে আমিও বলি, ''মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে..সমর্থকদের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।'' 

আরও পড়ুন: ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে আজ ওমানের বিরুদ্ধে নামছে ভারত, শেষবার দুই দলের লড়াইয়ে কী ঘটেছিল জানেন?