প্রিয়ক মিত্র
‘নধরের ভেলা’। ইংরেজি নাম, ‘দ্য স্লো ম্যান অ্যান্ড হিজ রাফ্ট’। ‘স্লো ম্যান’। বিদেশে একটি প্রাণী আছে। স্লথ তার নাম। তার চেয়েও ধীরগতির। এভাবেই বিক্রি করা হচ্ছে নধরকে। নধর কি বিক্রি হতে চেয়েছে? বোঝার আগেই সে বিক্রি হয়েছে। খেলা দেখাচ্ছে সার্কাসে। কী খেলা? যা সে করে, তাই। সে হাঁটে আশ্চর্য ধীরে, শম্বুকগতির চেয়েও ধীরে। তার হাঁটা বোঝা যায় না। কিন্তু সেই হাঁটা চট করে নজরে পড়বেই সাধারণ চোখে। কেন? কারণ, সেই হাঁটা আদতে একটা আশ্চর্য বিচ্যুতি। যে বাস্তব বেপরোয়া রকমের গতিশীল, তার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধীর মতো শ্লথ হয়ে থাকে নধর।
প্রদীপ্ত ভট্টাচাৰ্যর ছবি দেখতে বসলে ভয় করে। সেই টেলিছবি থেকে, সে ‘পিঙ্কি আই লাভ ইউ’ হোক, ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’ হোক, ‘কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল’ হোক, ‘সত্যি হলেও গল্প’ হোক— প্রদীপ্ত ভট্টাচাৰ্য বিচিত্র এক খেলা খেলেন। ছাপোষা কিছু চরিত্র, আমাদেরই মতো, তাদের জীবনে যে ওলটপালট যন্ত্রণা নিয়ে আসতে পারেন প্রদীপ্ত, সহজসরল জীবনে সহজসরল হিংসার, ভায়োলেন্সের আচমকা আবির্ভাবে, তা অস্বস্তিকর। তা বিষণ্ণ করে তো বটেই, কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধও করে দেয়। ‘নধরের ভেলা’ সেই দমচাপা অস্বস্তির প্রস্তুতি নিয়েই যেন শুরু হয়, মনে হয়, এই বুঝি সব গোলমাল হয়ে যাবে। হয়ে যায়ও। কিন্তু অন্য মোকামে।

ছবির গল্প নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আজ নজরুল তীর্থে দুপুর দেড়টায়, এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির দ্বিতীয় স্ক্রিনিং। অনেকেই এই ছবি আজ দেখবেন। যাকে পোশাকি ভাষায় ‘স্পয়লার’ বলে, তা ছবিকে কখনও নষ্ট করতে পারে না, যদি না চলচ্চিত্রভাষা কেবলমাত্র গল্পের ওই চমকটুকুর ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু ‘নধরের ভেলা’ নিয়ে কথা বলতে গেলে, একথাও মাথায় রাখতেই হবে, এই ছবির চলচ্চিত্রভাষ্য দাঁড়িয়ে রয়েছে আখ্যানের এমন এমন মোচড়ের ওপর, সেসব বলে দিলে ছবির অভিঘাত নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য। তাও, সেসব ঝঞ্ঝাট বাঁচিয়েও, দু’-একটা গুপ্তকথা এই ছবির সম্পর্কে বলতেই হবে, কারণ এই ছবি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গেলে, সেসব কথা না বললেই নয়।
প্রথমেই বলার, নধরের বিরল একটি রোগ আছে। যার জন্য নধর, কিঞ্চিৎ অমানবিকভাবেই, শ্লথ। কেন ‘অমানবিক’ বলা হচ্ছে? কারণ মানুষ কি এত ধীর, শ্লথ হাঁটতে পারে আদৌ? সার্কাসে যখন নধরের পরিচয় দেওয়া হয়, ‘মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু মানুষ নয়’— তখন তার এই স্বাভাবিক চলন নেহাতই ‘আইটেম’ হয়ে যায়। অথচ, সত্যি কি সে আইটেম? নয়। তার হাঁটা এমনটাই। কেন? এখন কেন তার এই অসুখ, তার উৎসসন্ধানে যাবে একমাত্র সেই দর্শক, যে কেবল যুক্তি দিয়ে আশপাশের বৈধ বাস্তবকেই মাপে। কিন্তু নধরের বাস্তব তো তারই বাস্তব, সিনেমা তার ভেলা হতে পারে কেবল? আমি, কোন যুক্তিতে, সেই বাস্তবকে নির্মমভাবে নস্যাৎ করতে পারি?

কিন্তু নধর অসহায় যেমন, তেমন সে কি আদতে শিল্পী নয়? তার মা, যে মায়ের মৃত্যু তার জীবনটাকে বদলে দেবে আমূল, সেই মা যখন তাকে অবতার সাজিয়ে গ্রামের লোকের সামনে বসিয়ে রাখে, সে আপত্তি জানায়, সে বলে, এই কাজ সে করবে না। সে বসে বসে মূত্রত্যাগ করে ফেলে। সে মূত্রভরা বালতি উলটে দেয়। খিদে পেলে ফাঁকা থালা মাটিতে ফেলে দেয়। নধর যা চায়, তার বিপ্রতীপে গিয়ে, কেবল গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য তাকে হোটেলে বাসন মাজতে হয়, সার্কাসের রঙচঙে তাঁবুতে তাকে হতে হয় না-মানুষ আকর্ষণ। হাতি, জিরাফ, বাঘ-ভাল্লুক সিংহর খেলা উবে গেছে সার্কাস থেকে। তার জায়গায়, এই বিচিত্র অ-মানুষ আছে। প্রাণীদের সঙ্গে যা করা যায় না, নধরের সঙ্গে তা করা যায়। যে সার্কাসের কলাকুশলীরা খেতে পায় না, সেই সার্কাসে অঢেল জোগান আসে পচা টমেটো, পচা ডিমের। সেসব অবাধে ছুড়ে দেওয়া যায় নধরের দিকে।
নধর কী চায়? যে হাঁটা, যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবিধি তাকে আলাদা করে রাখে, সেসব ছাড়িয়ে নধর তথাকথিত অকম্মাই হয়ে যেতে চায়, ভেলায় ভেসে যেতে চায়। কোথায়? সে জানে না। ‘ঝরনা যেমন বাহিরে যায়/ জানে না সে কাহারে চায়’, গন্তব্যহীন এই যাত্রাই নধরের উদ্দেশ্য, নধরের চাওয়া। তার বাবা ট্রাপিজ দেখাতে গিয়ে মৃত। মা-ও তাই সার্কাস আসার খবর শুনেই চঞ্চল হয়ে ওঠে, কোনও চেনা ট্রমা তার কাজ করে না। তাহলে সার্কাসের তাঁবুই কি নধরের আসল জায়গা? সেও কি একদিন ট্রাপিজের মতো কোনও খেলায় চৌখস হয়ে উঠবে? না কি সে ভেসে যাবে কেবল? তার মতো করে।

নধরের জীবনে দু’টি মূল ক্ষমতাকেন্দ্র। মা, ও হারাধন। মা চায় তাকে দুটো ভাত খাইয়ে রাখতে, মা তার ঘুমন্ত কপালে চুম্বন এঁকে সেই কোন ভোররাত ও সকাল থেকে, ভাঙা শরীর ও বয়সের পরোয়া না করেই, রীতিমতো অপমান সহ্য করেই, ছেলে অন্তপ্রাণ হয়ে থাকে। কিন্তু নধরকে ভগবান সাজায়ও তার মা, যা নধর চায় না। মায়ের মৃত্যুর পর পাথরবৎ নধরকে মদন শুভাকাঙ্ক্ষী সেজেই কখনও হোটেলে নিয়ে যায়, কখনও সার্কাসে। কিন্তু নধর তা-ও চায় না। সে খাপখোলা যৌনতার সামনে স্থবির হয়ে যায়, কখনও কখনও ডেকে ওঠে, ‘মা’ বলে।
আর আছে সার্কাসের তাঁবু। মিখাইল বাখতিন কথিত কার্নিভাল। সেখানে জীবন অসুন্দরহ নিপীড়িত, অথচ বন্য উন্মাদনার। সেই তাঁবুর হর্তাকর্তা হারাধন। সেও কি সমাজের চেনা ছকের? সে ঘিনঘিনে শয়তান। সার্কাসের সকলকে সে তুঙ্গ অত্যাচার করে কথায় কথায়, তার স্ত্রী যন্ত্রণায় বোবা হয়ে থাকে, সার্কাসের দুই নারী, শ্যামা ও রূপা তার কাছে নেহাতই ভোগ্য। এই হারাধন আর নধরের দেখা হয় ছবির মাঝখানে। ততক্ষণে সার্কাসের ভেতর প্রতিরোধী ষড়যন্ত্রর আভাস আমরা পেয়ে গেছি। কিন্তু নধর হারাধনের তুমুল অত্যাচারের সামনে স্থির হয়ে থাকে। একবার সে শুধু খেলা দেখায় না, হেসে ওঠে, এবং, একবার শ্লথ গতিতেই ‘শু-য়ো-রে-র বা-চ্চা’ বলে ওঠে। সার্কাসের সম্মিলিত প্রতিরোধের স্বর কি সে-ই বয়ে নিয়ে এসেছিল? শ্যামা, রূপা, রহমান সবাই স্বাধীন শিল্পী হতে চায়। তাও, শ্যামার অভিনয়ের চেয়ে রূপা ও রহমানের আসরমাতানো উলঙ্গবাহার নাচ, তার কাছাখোলা যৌনতার সুড়সুড়িই গ্রামের মানুষকে ধরে রাখে। কিন্তু কেবলই এই জনমোহন কি তারাও চায়?
এই ছবি স্বতন্ত্রভাবেই দুঃসাহসী বাজপাখির মতো উড়ান দিতে পারে। এই ছবির অভিনেতাদের ভাল অভিনয় করতেও হত। তাও যেকথা না বলা পাপ, অমিত সাহা যে অভিনয় করলেন এই ছবিতে, তা অভিনয়-শিক্ষার ক্লাসরুম। গোটা শরীরের ভার পায়ের ওপর রাখা, একটি দৃশ্যে হেসে ওঠার জন্য অস্বাভাবিক রকমের অভিব্যক্তিহীন থাকা, হাতেগোনা কয়েকটি সংলাপের অভিঘাত আলাদা আলাদাভাবে স্পষ্ট রাখা— এই ধাপগুলো লক্ষ করলে বোঝা যাবে, এই অভিনয় একবারই হতে পারে অভিনেতার জীবনে। অমিত সাহা দুরন্ত শক্তিশালী অভিনেতা। তিনি আরও বহু চমৎকার অভিনয় করবেন, কিন্তু নধর তাঁর ম্যাগনাম ওপাস হয়ে থাকবেই। এই দর্শককে চিড়বিড়িয়ে অশান্তি দেওয়া জঘন্য মানুষ হারাধনের চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তীও তেমন। এমন খল আবহেও, প্রতিটি তাকানো, দাঁতনখের আস্তিনে লুকিয়ে রাখা খুনে রাগ, ঠান্ডা রক্তের শয়তানির মধ্যে, মাদুলি খুলে মদ খেতে বসা হারাধন আদতে রক্তমাংসের মানুষ যে, তা ঋত্বিক চক্রবর্তী এই চরিত্রে অভিনয় না করলে কোনওমতেই বোঝানো যেত না। প্রিয়াঙ্কা সরকারের ক্ষেত্রেও, মাইলফলক হয়ে থাকবে শ্যামা। তুমুল আবেদনের মধ্যে, কাছাখোলা কামনার মধ্যে শিল্পীর বেদনা ও জেদের যে অভিনয় প্রিয়াঙ্কা করেছেন, তা এককথায়, অবিশ্বাস্য। তাঁকে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি সঠিকভাবে ব্যবহার করুক, এই দাবি রাখতেই হবে। অপরাজিতা ঘোষ সংলাপহীন এই চরিত্রে, কেবল মুখের ভাব দিয়ে শিউরে ওঠার মতো অভিনয় করেছেন। সায়ন ঘোষ, শতাক্ষী নন্দী, নিলয় সমীরণ নন্দী, কৌশিক রায়— যে সূক্ষ্ম তারের অভিনয়ে ও পারফরমেন্সে এই ছবির গতিকে ধরে রাখেন এই অভিনেতারা, তা সামগ্রিক চলচ্চিত্রটির সঙ্গে লগ্ন না হলে অসম্ভব ছিল। মায়ের চরিত্রে কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়ও যেন আদতে, নির্বিকল্প।

এই ছবির শিরদাঁড়া এই ছবির সংগীত। প্রচলিত গান থেকে যাত্রার তথাকথিত চটুল গান, বা ‘ভেসে যায় ভেলা/ বেলা-অবেলায়’-এর মতো গান, এবং আবহসংগীতে সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন, তাকে ভাষায় কুর্নিশ জানানো মুশকিলের। জয়দীপ দে-র ক্যামেরা কখনও সেই সংগীতের দোসর হয়। তাঁবুর ভেতর শরীরখেলার গান ও শ্মশানে ছিটকোনো অগ্নিশিখার সামনে মা হারানোর গান যেভাবে মেশে, তা অতুলন। শব্দের ব্যবহারেও সেই চমক। হাসি-কান্না-শীৎকার, জীবনের এই মৌলিক তিন শব্দ আবহসুরে মিশে থাকে। আর সেই জীবন পেরিয়ে যায় নধরের ভেলা।
এই ভেলা আদতে মনসামঙ্গলের। তাই মনসামঙ্গল যাত্রাপালার ভেতর দিয়ে ফিরে ফিরে আসে ছবিতে। সুবোধ ঘোষের গল্প বা ঋত্বিক ঘটকের ছবির জগদ্দলের মতো, অকেজো হয়েও নধর জ্বলে ওঠে রংমশালের মতো। বেহুলার ভেলার জন্যই কি? সেই ভেলাই কি তার মোক্ষ? বেহুলার ভেলা আদতে অনন্তকাল ধরে ভাসমান। কোনও না কোনও কাছের মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য। নধরের জন্য সে কে? মা? না কি অন্য কোনও জীবন?
এই ভেলা আদতে বাংলার আবহমানকালের।
