আজকাল ওয়েবডেস্ক: এক আন্তর্জাতিক গবেষকদল এমন এক নতুন অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছেন, যা বর্তমানে ব্যবহৃত প্রতিষেধকের তুলনায় বেশি কার্যকর ও সহজে উৎপাদনযোগ্য হতে পারে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত Nature জার্নালের এক গবেষণাপত্রে দলটি জানিয়েছে, এই নতুন পদার্থ হাজার হাজার প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হতে পারে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। এছাড়া, সাপের কামড়ে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ—অর্থাৎ ৫৪ লাখ আক্রান্তের মধ্যে ২৭ লাখ মানুষ—গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।


তবুও, সাপের বিষে আক্রান্ত হওয়া এখনও বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী ও অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ হিসেবে রয়ে গেছে, বিশেষত দরিদ্র অঞ্চলে। বর্তমানে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমেরও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এসব প্রতিষেধক সাধারণত ঘোড়ার মতো বড় প্রাণীর শরীরে অল্প পরিমাণ সাপের বিষ প্রবেশ করিয়ে তৈরি করা হয়। এতে খরচ বেশি হয়, উৎপাদন কঠিন, এবং প্রতিটি অ্যান্টিভেনম কেবল নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে কাজ করে। উপরন্তু, এই ধরনের অ্যান্টিভেনম অনেক সময় মানুষের শরীরে তীব্র ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।


এই সীমাবদ্ধতাগুলি মাথায় রেখে গবেষকরা এমন একটি প্রতিষেধক তৈরির লক্ষ্য নিয়েছিলেন যা আফ্রিকার এক ডজনেরও বেশি বিষাক্ত সাপের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে, টিস্যু ক্ষতি রোধ করতে পারবে, ইমিউন প্রতিক্রিয়া কমাবে এবং উৎপাদন খরচও কমাবে।


ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় নতুন অ্যান্টিভেনম “অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক” ফল দেখিয়েছে। দলটির অনুমান, অর্থ পেলে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে মানুষের উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা সম্ভব হবে।


বর্তমান অ্যান্টিভেনমের মতো প্রাণীর রক্তের উপর নির্ভর না করে, এই নতুন পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন “ন্যানোবডি”—অ্যান্টিবডির ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী অংশ। গবেষণার প্রধান লেখক ডেনমার্কের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির বায়োটেকনোলজি বিভাগের আন্দ্রেয়াস হাউগার্ড লাউস্টসেন-কিয়েল বলেন, “আমরা এমন এক অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছি, যার জন্য বারবার প্রাণী থেকে অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করতে হবে না। এর ফলে বিপুল পরিমাণে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন করা সম্ভব হবে, গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখেই।”


বর্তমানে আফ্রিকার কোনো একক অ্যান্টিভেনম নেই যা সব প্রাণঘাতী সাপের বিরুদ্ধে কার্যকর। প্রতি বছর উপ-সাহারান আফ্রিকায় প্রায় ৭,০০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। তাই দলটি উটজাতীয় প্রাণীর অ্যান্টিবডি থেকে আটটি ন্যানোবডির মিশ্রণ তৈরি করেছে, যা ১৮টি প্রজাতির সাপ—যেমন কোবরা, মাম্বা ও রিংখালস—এর বিষকে লক্ষ্য করে।


ন্যানোবডি সাধারণ অ্যান্টিবডির তুলনায় ছোট ও স্থিতিশীল। এগুলি শক্তভাবে বিষাক্ত টক্সিনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে, নতুন অ্যান্টিভেনম ১৮টির মধ্যে ১৭টি প্রজাতির বিষকে কার্যকরভাবে নিষ্ক্রিয় করেছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে ফল কিছুটা কম দেখা গেছে, যদিও ছয়টি প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রাণহানি রোধ হয়েছে।


গবেষকরা আরও দেখেছেন, ন্যানোবডি-ভিত্তিক অ্যান্টিভেনম টিস্যু ক্ষতি কমাতে সক্ষম এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ভবিষ্যতে চিকিৎসকেরা রোগীর উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারবেন।


যদিও এখনো এটি মানবদেহে পরীক্ষিত নয়, গবেষকদল আশাবাদী যে এটি সাপের কামড়ের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারবে। লাউস্টসেন-কিয়েল বলেন, “আমাদের নৈতিক ও বিশ্বের দায়িত্ব এই সমস্যা সমাধানে অবদান রাখা। এই অ্যান্টিভেনম পৃথিবীজুড়ে সাপের কামড়ের চিকিৎসার ধারণা বদলে দিতে পারে।”