উদ্দালক
জেমাইমা রডরিগেজ, আশ্চর্য একটা তারার নাম। যে উত্তরগুলো খুঁজতে-খুঁজতে মেয়েরা দিশেহারা, জেমাইমা, সেই সমস্ত হেরে যাওয়ার অশ্রুবিন্দু জড়ো করে গড়ে ওঠা আনন্দাশ্রুর সাগর। বৃহস্পতি রাতে যে ক’টা তারা বাণিজ্য নগরীর আকাশে উঠেছিল, তাঁরাও লালকমল-নীলকমলের মতো সাক্ষী রইল, আলোর পথযাত্রীর, জেমাইমা নামক ম্যাজিকের।
আমার মনে পড়ছিল সারিসারি মুখ। যে সহকর্মী মেনস্ট্রুয়েশনের যন্ত্রণায় ছুটি চেয়ে বসের কাছে শুনেছিল, ‘প্রতি মাসে ছুটি দিতে হবে নাকি! এই জন্য মেয়েদের সাংবাদিকতায় আসতে নেই।’ যে কম বয়সের অভিনেত্রী থিয়েটারের রিহার্সালে এসে ভয়ে কাঁটা হয়ে থেকেছে কখন ট্রেনিংয়ের নামে তাঁকে অন্যায় ভাবে স্পর্শ করবেন ডিরেক্টর। যে মহিলা গাড়ির চালককে রাস্তায় যানজটের মধ্যে দাঁড়িয়ে অকারণে শুনতে হয়েছে, ‘মেয়েদের গাড়ি চালাতে দিলে রাস্তার এই অবস্থা তো হবেই!’ তাদের মুখোশ ছিল জেমাইমার মুখে। এমন আরও অসংখ্য মুখ ঘাড় তুলে তাকিয়ে ছিল নবি মুম্বইয়ের সন্ধ্যাতারা জেমাইমার দিকে। সেই সমস্ত গুমরে থাকা কান্না আর যন্ত্রণা মৌসুমী বৃষ্টির মতো মিশে গেল বাইশ গজের ডানপাশের ঘাসে। হেলমেট খুলে, হাঁটু ভেঙে, উবু হয়ে বসে সেই যাবতীয় যন্ত্রণাকে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ১২৭ নট আউট, ভারতবাসীর নয়নের মণি জেমিমার জীবনে রয়ে গিয়েছে এক বড় আক্ষেপ, জানেন সেই গল্প?
একুশ শতক সাঁই-সাঁই করে আমাদের চারপাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। আমরা মনে করছি আমরা ছুটছি, সত্যি তাই? এ এমন এক দেশ, যেখানে খেলতে এসে বিদেশের মহিলা ক্রিকেটারদের শ্লীলতাহানীর মুখে পড়তে হয়। যে দেশে জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেন নিজের মেয়েকে তিনি ক্রিকেট খেলতে দিতে চান না। মেয়েদের ক্রিকেট ছাড়াও আরও অনেক কাজ আছে। যে দেশে একজন অভিনেত্রী অবসাদ নিয়ে কথা বললে, তা নিয়ে হেডলাইন হয়, লোকে বলে সিনেমার প্রচারের জন্য এসব ‘নাটক’ করছে, সেই সমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনার চুমু গ্রহণের ক্ষমতা ক’জনের আছে, সন্দেহ করি। আমি খেলা দেখে অবাক হয়েছি, ঠিকই। কিন্তু অবাক হয়েছি আপনাকে দেখে। চোখের জল বাঁধ মানছিল না, আপনি চাইছিলেনও না। ম্যাচের শেষে প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে গোটা প্রকাশ্যকে স্তম্ভিত করে আপনি বললেন, ‘হ্যাঁ আমাকে অবসাদ গ্রাস করেছিল। হ্যাঁ, আমি রান করতে পারছিলাম না, বারবার কাঁদতাম, রোজ, মা-বাবার কাছে, বন্ধু অরুন্ধতীর কাছে’। প্রেস কনফারেন্সেও সেই একই শিমুল ফুলের মতো স্বচ্ছ আপনার কথা। শেষ ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন খেলোয়াড়দের প্রেস কনফারেন্স শুনেছি, আবেগ তাড়িত ম্যাচের শেষের আবেগঘন বার্তা, কিন্তু কাউকে আপনার মতো মনে হয়নি জেমাইমা। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, আপনি ঝর্ণার মতো অবারিত ঝরছেন।

একটা ম্যাচ শেষ হল জেমাইমা। তবে আগাগোড়া আসল লড়াইটা এখনও যে রয়ে গেল। আপনার মতো নাইটেঙ্গেলের দিকে তাকিয়ে আছেন যে আমাদেরই দেশের অসংখ্য মেয়েরা। মেট্রোর ভিড়ে অচেনা মহিলার শরীরে স্পর্শ করা লোকটাও হয়ত বাড়ি ফিরে গিয়ে আপনার খেলা দেখে আনন্দ করেছে। হতে পারে, কর্মক্ষেত্রে মহিলা টিমমেটকে কুপ্রস্তাব দিয়ে বাড়ি ফিরে আসা পুরুষটি বাড়ি ফিরে আপনাকে নিয়ে এক প্যারাগ্রাফ লিখেছে। আগাগোড়া কোনও হিন্দুরাষ্ট্রের সমর্থক আপনার বাইবেল আওড়ানোর ভিডিও পোস্ট করে ফেসবুকে লিখেছে জয় হিন্দ! বারবার নিজের মেয়েকে কেরিয়ার গড়ার বদলে পাত্র খোঁজার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া বাবাও নিশ্চয়ই কালীপুজোর পড়ে থাকা বাজি ফাটিয়ে আপনার ইনিংসকে উদযাপন করেছে। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে লড়াইটা যে এখনও বাকি রয়ে গিয়েছে জেমাইমা। আপনার জড়িয়ে ধরার মতো, মা-বাবা, বন্ধুরা এখনও আছে, অনেকের তো তেমনও নেই। আপনার বড়-বড় চোখের প্রাণঢালা কথা, কখনও অসংলগ্ম বাক্য, কখনও মুখ ভরা হাসি কখনও ছলছলে চোখে কথা ওদের কাছে বাইবেল হয়ে এসেছে বৃহস্পতি রাতে। ওদের লড়াইটা এখনও বাকি আছে জেমাইমা। বাইশগজের নাছোড় লড়াইয়ে আপনি যতবার চক্রব্যুহ ভেঙে ছিটকে বেরিয়ে আসবেন, ততবার, অন্তত সেই রাতের জন্য মেয়েটা বাবার সামনে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে, ‘আমি ফুটবলার হতে চাই, বিয়ে করতে চাই না’। তাই আপনার রোজ খেলাটা জরুরি, জরুরি অভিমান মাখা আনন্দ আর কান্নার, যা আসলে মাথা তুলে দাঁড়াবে শিশিরবিন্দুর মতো।
ছেলেদের ক্রিকেটে ভারত জিতলে কেউ লেখে না, ‘পুরুষদের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়াকে দুরমুশ করল ভারত।’ মেয়েরা জিতলে লিখতে হবে, ‘মেয়েদের ক্রিকেটে ভারতের উজ্জ্বল দিন!’ এই দূরত্ব যতদিন আছে জেমাইমা, ততদিন লিঙ্গ ভেদে জাতীয় ক্রিকেটারদের বেতনের ফারাক থাকবে। এর বিরুদ্ধে এতবছর ধরে লড়ছেন আপনারা, এ আপনাদের একান্ত ব্যক্তিগত লড়াই। কোনও পুরুষের ক্ষমতা নেই আপনাদের হয়ে সেই লড়াই করার। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন আপনারা। ইস্তক পেরনো পথ, কঠিন, মারাত্মক কঠিন। কিন্তু তাও যে ক্লান্তির পথ ফুরোতে চায় না। ভারতের মতো দেশে আরও কঠিন সেই পথ পেরনো। কিন্তু পেরোতেই হবে সেই পথ।
আমি আবারও এমন কোনও এক আসন্ন শীতের রাতে আলগোছে খেলা দেখতে দেখতে খুঁজে পাব লড়াই করে টিকে থাকা আমার মায়ের মুখ। আপনার কান্না দেখে ক্রিকেট না বোঝা মা-ঠাকুমার আঁচল চাপা চোখ ছলছল দেখে বুঝতে পারব, আমরা পারিনি, আমরা ছেলেরা পারব না। একমাত্র মেয়েরাই পারবে, শরীর টানতে-টানতে, দাঁতে-দাঁত চেপে অসম্ভব একটা রান চেস করতে। যে রান আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব হলেও, অসম্ভব কখনই নয়। তারপর ভ্যাবলার মতো বসে বসে দেখব কাজল নয়না হরিণীর মতো আপনার ছুটে আসা, লাফিয়ে পড়া, কেঁদে-কেটে একাকার করা। ২৫ বছরের আপনাকে দেখে যাঁরা এক শতাংশও সাহস সঞ্চয় করে শুক্রবার গ্রাম-শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল, তাঁদের চোখে জেমাইমা সন্ধ্যাতারা হয়ে ফুটবেন, ফুটতেই হবে আপনাকে। আমি ভ্যাবলার মতো বসে দেখতে থাকব। এমন এক দিনের অপেক্ষায় আছি। বসে আছি। আপনি আর কোনওদিন রান না করলেও আছি, করলেও আছি। বলুন, আমি বলছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে ভোররাতের ছাদে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করুন;
‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ'রে যায়-
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি’।
