আজকাল ওয়েবডেস্ক: ‘আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন!’ গানটি ছাড়া যেমন শ্যামাপূজা কল্পনা করা কঠিন ঠিক তেমনই, ফল-মিষ্টি, বস্ত্র-অলঙ্কারের মাঝে একটি জিনিস না থাকলে মায়ের পুজো যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই জিনিসটি হল টকটকে লাল জবা। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কি, হাজারো ফুলের মাঝে কেন এই রক্তজবাই মা কালীর এত প্রিয়? কেন জবা ফুল ছাড়া মায়ের আরাধনা ভাবাই যায় না?

এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে পুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র এবং প্রতীকী ব্যঞ্জনার গভীরে। দেবী কালীর রূপ ভয়ঙ্কর, তিনি মহাকালের স্ত্রী, সৃষ্টি ও ধ্বংসের নিয়ন্ত্রক। তাঁর গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, গলায় মুণ্ডমালা, এবং করাল জিহ্বা মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই ভয়াল রূপের সঙ্গে জবা ফুলের নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।
প্রথমত, জবা ফুলের টকটকে লাল রং। এই রং রক্ত ও শক্তির প্রতীক। দেবী কালী স্বয়ং আদ্যাশক্তি, রজোগুণের প্রতীক। তিনি একদিকে যেমন অসুরদের রক্তে প্লাবিত করেন, তেমনই তাঁর ভক্তদের রক্ষা করেন। জবার এই গাঢ় লাল রং দেবীর সেই রুদ্রমূর্তি, তাঁর সংহারকারিণী রূপ এবং সৃষ্টির চালিকাশক্তিকে প্রকাশ করে। তাই জবা নিবেদনের মাধ্যমে ভক্ত দেবীর এই মহাশক্তিকেই বন্দনা করেন।

দ্বিতীয়ত, জবা ফুলের আকৃতি। একটি জবা ফুলকে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তার পাঁচটি পাপড়ি এবং মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি লম্বা পুংকেশর। তন্ত্রমতে, এই পাঁচটি পাপড়ি পঞ্চ মহাভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) বা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) প্রতীক। ভক্ত যখন দেবীর চরণে জবা ফুল অর্পণ করেন, তখন তিনি আসলে তাঁর জাগতিক সমস্ত ইন্দ্রিয়সুখ, তাঁর অহংবোধ, পঞ্চভূতে গড়া এই নশ্বর দেহকেই মায়ের কাছে সমর্পণ করেন।
শুধু তাই নয়, জবা ফুলের মাঝের যে অংশটি জিহ্বার মতো বেরিয়ে থাকে, সেটিকে দেবীর লোলজিহ্বার প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, অসুরদের বধ করার পর সংহার রূপে মত্ত কালী যখন ভুলবশত স্বামী মহাদেবের বুকে পা তুলে দেন, তখন লজ্জায় তিনি জিভ কেটেছিলেন। জবার ওই আকৃতি সেই পৌরাণিক ঘটনার কথাই স্মরণ করায়। তাই এই ফুল নিবেদনের মাধ্যমে দেবীর প্রতি ভক্তের ঐকান্তিক আত্মসমর্পণ প্রকাশ পায়।
আরও পড়ুন: অন্য জাতের সঙ্গে সঙ্গম, তাতে জন্মানো সন্তানরাই বদলে দিচ্ছে বংশের স্বভাব-চরিত্র! এ কী দেখলেন গবেষকরা?

শক্তি উপাসনার অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ‘মহানির্বাণ তন্ত্র’-এ উল্লেখ রয়েছে, দেবী কালী জবা ফুলেই সর্বাধিক প্রীত হন। সেখানে বলা হয়েছে, একটি মাত্র রক্তজবা দিয়ে দেবীর পুজো করলে হাজার বছরের পুজোর ফল লাভ করা যায়। শাক্তধর্মে এই ফুলের গুরুত্ব এতটাই যে, একে “ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশাং” মন্ত্রের মাধ্যমে দেবীর রূপের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
আরও পড়ুন: ৭ কোটি শুক্রাণু চাই! চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ৫০ সঙ্গীর সঙ্গে একটানা সঙ্গম রানিমার! কোথায় থাকে এই রানি?
তাই জবা ফুল নিছকই একটি পুজোর উপাচার নয়, এটি ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এর রং, রূপ এবং গঠনের প্রতিটি অংশ দেবী কালীর শক্তি, তত্ত্ব এবং মাহাত্ম্যের প্রতীক। এই কারণেই যুগ যুগ ধরে কালী আরাধনায় রক্তজবার স্থান সবার উপরে, অবিচল। জবা ছাড়া তাই মায়ের পুজো ভাবাটাই যে অসম্ভব!