আজকাল ওয়েবডেস্ক: চিরাচরিত প্রেমের ধারণা কি তবে সত্যিই বদলে যাচ্ছে? অন্তত জেন-জি’র অভিধান তো সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। যেখানে একসময় ছিল ‘প্রেম’ বা ‘সম্পর্ক’, সেই জায়গা দখল করছে ‘সিচুয়েশনশিপ’, ‘ব্রেডক্রাম্বিং’-এর মতো আধুনিক সব ট্রেন্ড। এই তালিকার সাম্প্রতিকতম সংযোজন ‘ব্লুটুথিং’ এবং ‘হটস্পটিং’।
কথাগুলো শুনতে যতই অদ্ভুত লাগুক, এর অর্থ জড়িয়ে আছে সম্পর্কের সমীকরণের সঙ্গেই। আর সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা বাড়ার পিছনে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার তীব্র মোহ এবং বাস্তববাদের নামে এক অদ্ভুত লেনদেনের মানসিকতা।
ব্লুটুথিং এবং হটস্পটিং ঠিক কী?
প্রথমে আসা যাক সংজ্ঞায়। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এই দুই শব্দের অর্থ আমরা সকলেই জানি। কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা।
ব্লুটুথিং: এই প্রবণতাটি অনেকটা ডিভাইসের ব্লুটুথ সংযোগের মতোই। ধরা যাক, কোনও পার্টিতে বা কাফেতে দু’জন মানুষের দেখা হল। তাঁরা কাছাকাছি এলেন, কথাবার্তা হল, একে অপরের প্রতি হয়তো ক্ষণস্থায়ী আকর্ষণও বোধ করলেন। কিন্তু সেই সংযোগটি ওই জায়গার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পার্টি শেষ, সম্পর্কও শেষ। অর্থাৎ, যতক্ষণ দু’জন একে অপরের ‘রেঞ্জ’-এর মধ্যে থাকছেন, ততক্ষণই সংযোগ থাকছে। এর মধ্যে কোনও গভীর দায়বদ্ধতা বা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নেই। এটি একটি চূড়ান্ত ক্ষণস্থায়ী এবং সুবিধাবাদী আলাপচারিতা মাত্র।
হটস্পটিং: এই প্রবণতাটি আরও বেশি হিসেবি এবং এক কথায় ‘সুবিধাবাদী’। মোবাইলের ডেটা শেষ হয়ে গেলে আমরা যেমন অন্যের ফোনের ‘হটস্পট’ খুঁজে বেড়াই, ঠিক তেমনই এই ধরনের সম্পর্কে এক জন ব্যক্তি অন্য এক জনকে স্রেফ তাঁর ‘রিসোর্স’ বা সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের জন্য ‘ডেট’ করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে ‘রিসোর্স’ মানে শুধুই অর্থ নয়। হতে পারে সেই ব্যক্তির সামাজিক প্রতিপত্তি, তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, সুন্দর ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, অথবা অভিজাত পার্টিতে ঢোকার ছাড়পত্র। যে ব্যক্তি এই সুবিধাগুলো ভোগ করার জন্য সম্পর্কে জড়াচ্ছেন, তিনি হলেন ‘হটস্পটার’ এবং যাঁর থেকে এই সুবিধা নেওয়া হচ্ছে, তিনি হলেন ‘হটস্পট’। সোজা কথায়, প্রেম বা আবেগের এখানে কোনও স্থান নেই, সম্পর্কটি পুরোপুরি ‘ট্রানজাকশনাল’ বা লেনদেন ভিত্তিক।
আরও পড়ুন: নারী-পুরুষ সকলেই নগ্ন হয়ে ঘোরেন! একটি সুতোও থাকে না গায়ে! দেখুন বিখ্যাত সব ‘নগ্ন সৈকত’-এর ছবি
কেন বাড়ছে এই প্রবণতা?
সমাজতাত্ত্বিক এবং মনোবিদরা এই নতুন প্রবণতার বাড়বাড়ন্তের পিছনে একাধিক কারণকে দায়ী করছেন।
১। সোশ্যাল মিডিয়া ও ‘ক্লআউট’ সংস্কৃতি
তরুণ প্রজন্মের কাছে এখন ‘দেখানো’ বা ‘শো-অফ’ করাটা জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনস্টাগ্রাম-সর্বস্ব জীবনে কে কত দামী জায়গায় যাচ্ছে, কত ভাল ছবি পোস্ট করছে, তার উপর নির্ভর করে সামাজিক ‘ভ্যালু’। ‘হটস্পটিং’-এর মাধ্যমে অনেকেই তাঁদের সঙ্গীর জীবনযাত্রাকে নিজের বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। একজন ‘হাই-ভ্যালু’ বা প্রভাবশালী সঙ্গীর হাত ধরে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলকেও জনপ্রিয় করে তোলা এর মূল উদ্দেশ্য।
২। অর্থনৈতিক চাপ এবং বস্তুবাদ
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটানো অনেকের কাছেই অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। কিছু ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম সামাজিক সিঁড়ি টপকানোর ‘শর্টকাট’ হিসেবে এই ‘হটস্পটিং’-কে বেছে নিচ্ছে। সঙ্গীর টাকায় দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়া, ছুটি কাটানো বা দামী উপহার পাওয়াকে তাঁরা ‘স্মার্ট মুভ’ হিসেবেই দেখছেন। আবেগ বা ভালবাসার চেয়েও এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে জীবনযাত্রার মান।
৩। দায়বদ্ধতার ভয় (কমিটমেন্ট ফোবিয়া)
‘ব্লুটুথিং’-এর বাড়বাড়ন্তের কারণ হল দায়বদ্ধতার প্রতি ভয়। জেন-জি’র একটা বড় অংশ কোনও রকম গভীর বা স্থায়ী সম্পর্কে জড়াতে চান না। তাঁরা মনে করেন, একটি সম্পর্কে আটকে পড়া মানে জীবনের অন্যান্য সুযোগ (বিশেষত অন্য মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ) হারিয়ে ফেলা, যাকে বলে ‘ফোমো’ (ফিয়ার অফ মিসিং আউট)। ‘ব্লুটুথিং’ তাঁদের সেই সুবিধা দেয়। সহজ আলাপ, কোনও দায়বদ্ধতা নেই, এবং সহজ বিচ্ছেদ- এই মডেলেই তাঁরা বেশি স্বচ্ছন্দ।
আরও পড়ুন: নারী-পুরুষ সকলেই নগ্ন হয়ে ঘোরেন! একটি সুতোও থাকে না গায়ে! দেখুন বিখ্যাত সব ‘নগ্ন সৈকত’-এর ছবি
মনোবিদদের মতে, এই প্রবণতাগুলো দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ‘হটস্পটিং’ সম্পর্কের ভিতকে পুরোপুরি ব্যবসায়িক করে তোলে, যেখানে বিশ্বাস বা আবেগের কোনও জায়গা থাকে না। অন্যদিকে, ‘ব্লুটুথিং’-এর মতো ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কগুলি আদতে মানুষের একাকিত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। বাইরে থেকে দেখতে যতই চটকদার লাগুক, এই সম্পর্কগুলি আসলে গভীর মানসিক সংযোগ তৈরিতে ব্যর্থ, যা আখেরে এক শূন্যতার জন্ম দেয়।
