আজকাল ওয়েবডেস্ক: ‘হাতের মুঠোয় গোটা বিশ্ব’- এই ভেবেই আজকাল বহু অভিভাবক সন্তানের শৈশবেই তার হাতে তুলে দিচ্ছেন ঝকঝকে স্মার্টফোন। পড়াশোনা থেকে বিনোদন, সবেতেই স্মার্টফোন হয়ে উঠছে অপরিহার্য। কিন্তু এই ‘স্মার্ট’ যন্ত্রই কি অজান্তে শিশু মনে গভীর ‘বিষ’ ঢেলে দিচ্ছে? সাম্প্রতিক এক চাঞ্চল্যকর সমীক্ষা অন্তত সেই অশনি সঙ্কেতই দিচ্ছে। মনোবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদদের কপালে গভীর ভাঁজ ফেলা এই সমীক্ষা জানাচ্ছে, যে শিশুরা ১৩ বছর বয়সের আগেই স্মার্টফোনের জগতে প্রবেশ করছে, যৌবনে পা দেওয়ার আগেই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সমীক্ষার পরিসংখ্যান রীতিমতো ভয়ের। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, যত কম বয়সে শিশুর হাতে ফোন আসছে, বিপদের ঝুঁকি ততটাই ঊর্ধ্বমুখী। বয়সের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের এই সম্পর্কটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। উদাহরণস্বরূপ, যে সমস্ত বালিকা ৫ বা ৬ বছর মতো অত্যন্ত কাঁচা বয়সে প্রথমবার মোবাইল ফোন হাতে পেয়েছেন, তাঁদের প্রায় ৪৮ শতাংশই পরবর্তী জীবনে আত্মহননের চিন্তা বা প্রবণতার (সুইসাইডাল আইডিয়েশন) শিকার হয়েছেন। অথচ, যে বালিকারা অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে, অর্থাৎ ১৩ বছর বা তার পরে ফোন পেয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতার হার প্রায় ২৮ শতাংশ। শতাংশের এই বিশাল ফারাক স্পষ্ট করে দিচ্ছে, শৈশবের অপরিণত মস্তিষ্কে ডিজিটাল জগতের প্রভাব কতটা গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
কিন্তু কেন এই ভয়াবহ প্রবণতা? বিশেষজ্ঞরা এর নেপথ্যে একাধিক কারণকে চিহ্নিত করছেন।
১। সোশ্যাল মিডিয়ার বিষাক্ত পরিবেশ: স্মার্টফোন হাতে আসা মানেই সোশ্যাল মিডিয়ার অবারিত দ্বার খুলে যাওয়া। শৈশবের কাঁচা মনে ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ বা ‘শেয়ার’-এর অন্তহীন দৌড়, বন্ধুদের ‘পারফেক্ট’ জীবনের অবাস্তব প্রদর্শনী এক তীব্র তুলনামূলক চাপ তৈরি করে। যা থেকে জন্ম নেয় হীনম্মন্যতা এবং নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা।
২। ঘুমের চক্র বিপর্যস্ত হওয়া: স্ক্রিনের নীল আলো এবং গভীর রাত পর্যন্ত চ্যাটিং বা গেম খেলার নেশা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ঘুমের চক্রকে (স্লিপ সাইকেল) সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, মেজাজ খিটখিটে করে তোলে।
৩। সাইবারবুলিং-এর থাবা: ডিজিটাল জগতে হেনস্থা বা সাইবারবুলিং আজকাল এক জ্বলন্ত সমস্যা। এই হেনস্থা যে কারও সঙ্গে হতে পারে, তা থেকে পালানোর কোনও সহজ পথ নেই। এই লাগাতার মানসিক নির্যাতন শিশুর আত্মমর্যাদাকে (সেল্ফ-ওয়ার্থ) ধূলিসাৎ করে দেয়।
৪। পারিবারিক সম্পর্কের শৈথিল্য: যে সময়টা শিশুর মা-বাবা বা ভাই-বোনের সঙ্গে কথা বলে, খেলে বা স্রেফ সময় কাটিয়ে মানসিক বন্ধন দৃঢ় করার কথা, সেই মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে স্ক্রিন। ডিভাইসে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে মানসিক বিচ্ছিন্নতা (ইমোশনাল ডিটাচমেন্ট)।
এই সবকিছুর মিলিত প্রভাবেই যৌবনে পা দেওয়ার আগেই ওই নাবালক নাবালিকারা আক্রান্ত হচ্ছে গভীর উদ্বেগ (অ্যাংজাইটি), দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ (ডিপ্রেশন) এবং আগ্রাসী মনোভাবের মতো মানসিক সমস্যায়। সমীক্ষায় স্পষ্ট, এই শিশুদের মধ্যে বাস্তব জগত থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি। তারা নিজেদের একটি খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছে, ভুগছে তীব্র আত্মবিশ্বাসের অভাবে। নিজের চেহারা বা ক্ষমতা সম্পর্কেও তৈরি হচ্ছে এক নেতিবাচক ধারণা (পুওর সেল্ফ-ইমেজ), যা তাদের সামাজিক মেলামেশায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন: একসঙ্গে থাকলেই অশ্রাব্য গালাগালি করে, পাঁচ বন্ধুকে আলাদা থাকতে বাধ্য করল কর্তৃপক্ষ
তবে এই সমীক্ষা সরাসরি প্রমাণ করে না যে স্মার্টফোনই মানসিক রোগের একমাত্র কারণ। কিন্তু এই জোরালো সম্পর্ক (স্ট্রং অ্যাসোসিয়েশন) এক স্পষ্ট সতর্কবার্তা দিচ্ছে। মনোবিদদের মতে, বিষয়টি ফোন হাতে তুলে দেওয়া বা না দেওয়ার বাইনারি তর্কের ঊর্ধ্বে। আসল প্রশ্ন হল, অভিভাবকরা এই ডিজিটাল জগতের বিপদ সম্পর্কে কতটা সচেতন? শৈশবে অবাধ এবং নিয়ন্ত্রণহীন ডিজিটাল সুবিধা কি আদতে শিশুর মানসিক সুস্থতার ক্ষতি করছে? এই প্রশ্নই এখন ভাবিয়ে তুলছে সচেতন সমাজকে।
