আজকাল ওয়েবডেস্ক: সালটা ১৯৯৩। তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের 'দাপুটে নেত্রী' তথা সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যের ক্ষমতায় রয়েছে জ্যোতি বসুর সরকার। এ সময় সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে ছাপ্পা-রিগিং-এর অভিযোগ নিয়মিত শোনা যায় বিরোধিদের মুখে। এমন আবহেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন তৎকালীন তখনকার যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা। 

প্রথমে এই কর্মসূচি দিন ঠিক হয়েছিল ১৪ জুলাই। কিন্তু, সে বছর ওই সময় প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের প্রয়াণের জন্য কর্মসূচি পিছিয়ে ২১ জুলাই করা হয়।

মমতা ব্যানার্জি, তাঁর ডাকে তোলপাড় হত জাতীয়বাদীদের হৃদয়। উসকে উঠত কাস্তে-হাতুড়ির অবসানের স্বপ্ন। সেবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মমতার ডাকে মহাকরণ অভিযানের জন্য কলকাতার রাজপথে নেমেছিলেন কয়েক হাজার যুব কংগ্রেসকর্মী। তৎকালীন রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক সচিবালয়ে এই অভিযান রুখতে মরিয়া ছিল পুলিশও। 

আরও পড়ুন-  গাড়ি নিয়ে বেরোলে খেয়াল রাখুন, ২১ জুলাই যান নিয়ন্ত্রণ শহরের এই রাস্তাগুলিতে, কলকাতা পুলিশের বিশেষ নির্দেশিকা

২১ জুলাই সকাল ১০টা থেকে মহাকরণ অভিযানের জন্য জমায়েত শুরু হয়। কলকাতার পাঁচটি জায়গা থেকে যাত্রা শুরু হয়।  এগোতে থাকেন যুব কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা। পুরোভাগে ছিলেন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা নিজে। বিভিন্ন মিছিলে ছিলেন সৌগত রায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মদন মিত্ররা। মধ্য-কলকাতার ধর্মতলা, ডালহাউসি স্কোয়ার সংলগ্ন বিভিন্ন ক্রসিং-এ গড়া হয় ব্যারিকেড। মহাকরণে পৌঁছনোর আগে পাঁচ দিক থেকে ব্যারিকেড করে তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ। তাতেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। শুরু হয় ধুন্ধুমার। পুলিশের সঙ্গে সংঘাত বেঁধে যায় যুব কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের। 

পুলিশি বাধা ঠেকাতে শুরু হয় ইট-পাথরবৃষ্টি। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে পাল্টা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় মেয়ো রোড-রেড রোডের মোড়ে। বোমাও পড়ে। সারা কলকাতা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। পুলিশের ভ্যানে অগ্নি সংযোগের মতো ঘটনাও ঘটে বলে অভিযোগ। বিক্ষোভকারীরা এগোতে থাকে, পিছু হঠতে শুরু করে পুলিশ। এরপর আচমকা গুলি চালাতে শুরু করে মরিয়া পুলিশবাহিনী। আর তাতেই প্রাণ যায় ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর। 

মৃত্যু হয়, বন্দনা দাস, মুরারী চক্রবর্তী, রতন মণ্ডল, কল্যান ব্যানার্জি, বিশ্বনাথ রায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী, শ্রীকান্ত শর্মা, দিলীপ দাস, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ দাস, মহম্মদ খালেক, ইনু-র। পরবর্তীকালে কংগ্রেসিরা এই ১৩ জনকে 'শহিদ' নামে ডাকতে শুরু করেন।

আরও পড়ুন- স্মরণ করলেন শহিদদের, তোপ দাগলেন বিরোধীদেরও, ধর্মতলায় মঞ্চ পরিদর্শনে গিয়ে মমতা বললেন, ‘বাকি কথা কাল হবে’

এই ১৩ যুব কংগ্রেসকর্মীর মৃত্যুতে রীতিমতো উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। কার নির্দেশে গুলি চালাল পুলিশ, এই প্রশ্নের আজও মীমাংসা হয়নি। উল্লেখ্য, সেসময় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যদিও পরবর্তীকালে এ ঘটনায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ক্নিনচিট দিয়েছিল সিবিআই। কার নির্দেশে পুলিশ সেদিন গুলি চালিয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।

১৯৯৩ সালের এই ঘটনার পর থেকেই প্রতিবছর এই দিনটিকে 'শহিদ দিবস' হিসেবে পালন করে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস। পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সালে মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল তৈরি করেন। তখন থেকেই ২১ জুলাইকে 'শহিদ দিবসে'র মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে তৃণমূলের 'শহিদ দিবস'ই যাবতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

২১ জুলাই মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক জীবনে এক উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন। ২১ মানেই মমতার কাছে স্মৃতি রোমন্থন, অতীতকে ফিরে দেখা, শহিদদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ। পাশাপাশি এ দিনের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই তৃণমূল সুপ্রিমো আগামীতে দলের পথ চলার পথনির্দেশিকা দেন।