আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমা হামলার মাধ্যমে যে পারমাণবিক যুগের সূচনা হয়েছিল, সেই ভয়াবহতার ছায়া আবারও ঘনিয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে বুলেটিন অফ অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বকে সতর্ক করতে শুরু করে তথাকথিত ‘ডুমসডে ক্লক’ বা সর্বনাশের ঘড়ি। এর কাঁটা যদি মধ্যরাত ছোঁয়, তবে তা মানব সভ্যতার পরিসমাপ্তি নির্দেশ করে। বর্তমানে রাশিয়া ও ইসরায়েলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য পারমাণবিক হুমকি এবং অস্ত্র প্রস্তুতির কারণে ঘড়িটি নেমে এসেছে মাত্র ৮৯ সেকেন্ডে—যা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকটতম সময়।

অস্ত্র হ্রাস থেকে অস্ত্র দৌড়ে

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটায় ১৯৯১-৯৬ সময়ে বিশ্ব সবচেয়ে দূরে ছিল এই ভয়াবহ মুহূর্ত থেকে—১৭ মিনিটে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে START I ও II চুক্তি হয়েছিল, যা পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারকে ৭০ হাজার থেকে ১৬ হাজারে নামিয়ে আনে। ইউক্রেন, কাজাখস্তান ও বেলারুশ ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী তাদের অস্ত্র ছেড়ে দেয়। এর বিনিময়ে রাশিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেন সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালিয়ে রাশিয়া এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে।

ইতিবাচক অগ্রগতি ও তার ভাঙন

১৯৯০-এর দশকে কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়—পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (CTBT), আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল (NWFZ), এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ভারত-পাকিস্তান ও ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র Anti-Ballistic Missile Treaty থেকে বেরিয়ে আসার পর বিশ্বজুড়ে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রকল্প এবং রাশিয়ার মহাকাশে পারমাণবিক মহড়ার আশঙ্কা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।

চুক্তি ভঙ্গ ও আঞ্চলিক অস্থিরতা

২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র INF Treaty থেকেও বেরিয়ে আসে, ফলে স্থলভিত্তিক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আবার বৈধ হয়ে যায়। ভারত, চীন, পাকিস্তান এই সুযোগে নিজেদের ভাণ্ডার বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের NWFZ চুক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। মরিশাসের ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ মার্কিন ঘাঁটির জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং অস্ট্রেলিয়ার AUKUS চুক্তি নতুন করে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন: হাজার হাজার পুরুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করছেন স্ত্রী' দের নগ্ন, সঙ্গমের ভিডিও, ভর ধরাচ্ছে 'মাই ওয়াইফ স্ক্যান্ডাল'

পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বিপদ

সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায়। ইরান এখনও সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র বানায়নি, তবে ইজরায়েল-আমেরিকার আক্রমণাত্মক অবস্থানের কারণে পরিবর্তন আসতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সবচেয়ে বিপজ্জনক। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ, ২০১৯ সালের বালাকোট আক্রমণ, আর ২০২৫ সালের পহেলগাঁও  হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিমান হামলা পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে। পাকিস্তান তার ‘লাল দাগ’ বা red line স্পষ্ট করেছে—ভারতীয় সেনা যদি গভীরভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়, তবে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভাববে। ভারতের সরকারি নীতি ‘No First Use’ হলেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হুমকি, বিশেষ করে সিন্ধু জল চুক্তি (IWT) স্থগিত করার সিদ্ধান্ত, পাকিস্তানের খাদ্য ও কৃষি নির্ভরতার জন্য সরাসরি হুমকি। ফলে যুদ্ধের সম্ভাবনা আরও বেড়েছে।

সম্ভাব্য সমাধান ও সীমাবদ্ধতা

বিশেষজ্ঞরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন—

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি CTBT অনুমোদন করে, রাশিয়াও যোগ দেবে এবং ভারত-পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়বে।

দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করতে পারে যাতে No First Use অঙ্গীকারকে নতুন মাত্রা দেওয়া যায়।

মধ্যপ্রাচ্যে Weapons of Mass Destruction Free Zone গঠনের জন্য ইসরায়েলকে চাপে রাখা উচিত।

দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সীমান্তে ডিমিলিটারাইজড জোন গড়ে তোলা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ও নেপাল নিজেদের একক রাষ্ট্রভিত্তিক NWFZ ঘোষণা করতে পারে, যা ভারত-পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করবে।

 

বর্তমান পারমাণবিক দৌড় মানবজাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons (TPNW) নৈতিক ও আইনগত মানদণ্ড তৈরি করেছে, কার্যকর বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নেই। তাই কেবল জনগণের আন্তর্জাতিক চাপই পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলিকে সংযমে আনতে পারে। অন্যথায় ৮৯ সেকেন্ড থেকে মধ্যরাতের দূরত্ব আরও কমতে বেশি সময় লাগবে না।