আজকাল ওয়েবডেস্ক: কাঠমান্ডুর দমকলবাহিনী বুধবার সকাল পর্যন্ত আগুন নেভানোর লড়াই চালিয়েছে। সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, সিংহ দরবার, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সচিবালয়, এমনকি একাধিক সুপারমার্কেট পর্যন্ত—মঙ্গলবার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জেন জেড প্রজন্মের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দুষ্কৃতীরা এগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। রাজধানীর আকাশজুড়ে এখনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরছে।

এদিকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি কোথায় আছেন তা নিয়ে নেপালি রাজনৈতিক মহলে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। চীন কেন্দ্রিক মনোভাবাপন্ন সিপিএন (ইউএমএল) নেতার পদত্যাগের পর সেনাবাহিনী কী ভূমিকা পালন করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে অলি ও কয়েকজন মন্ত্রীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিলেও একই সময়ে পুলিশ সদস্যদের লাঞ্ছনা ও সরকারি ভবন পুড়িয়ে দেওয়া ঠেকাতে কার্যত নিষ্ক্রিয় থেকেছে বলে অভিযোগ। অনেকেই মনে করছেন, সেনা নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে তাঁকেই পদত্যাগে বাধ্য করেছে।

প্রাক্তন কূটনীতিক এম. কে. ভদ্রকুমার সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, “বিশ্ব যখন নেপালে স্পষ্টভাবে এক ‘কালার রেভল্যুশন’-এর ছাপ দেখছে, দিল্লি তখন কার্যত অন্ধকারে।” তাঁর মতে, এই সময়ে মার্কিন প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই এনজিও ও শিক্ষা প্রকল্পের নামে বিপুল অর্থ নেপালে ঢালছে। শুধু গত বছরেই ইউএসএআইডি নেপালের শিক্ষা খাতে ৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে বিদেশে প্রশিক্ষণ ও ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের ধাঁচে এখানেও একই কৌশল দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পর্যবেক্ষকরা।

আরও পড়ুন: সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, আর কী দাবি নেপালের জেন জি প্রতিবাদীদের

কমিউনিস্ট সহানুভূতিশীল বিশ্লেষক আনন্দ স্বরূপ ভার্মা প্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, এই আন্দোলনের পেছনে কোনও ‘গোপন হাত’ রয়েছে। তাঁর মতে, সেনাবাহিনী যদি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবে সেটি বাংলাদেশ মডেলের মতো পরিকল্পিত পদক্ষেপ হতে পারে। তিনি মনে করিয়ে দেন, অলি নিজেই সেনাবাহিনীকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে উৎসাহ দিয়েছিলেন, যখন ২০১৫ সালের পর ভারতীয় প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে।

অন্যদিকে, ফরাসি বিশ্লেষক আরনো বের্ত্রাঁ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, নেপালে কার্যত রাষ্ট্র কাঠামো বড় শহরের বাইরেই ভেঙে পড়েছে। পুলিশ-প্রশাসন নেই বললেই চলে, সাধারণ মানুষ নিজেরাই আইন প্রয়োগ করে। তিনি মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে কোনও বিশেষ সুবিধা হবে না। “চীন হিমালয়ের ওপারে নির্লিপ্ত থাকবে, ভারতও সহজেই চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। মার্কিন স্বার্থে এখানে কোনও বড় কৌশলগত লাভ নেই,” মন্তব্য করেন বের্ত্রাঁ।

রাজনৈতিক অস্থিরতার এই আবহে নেপাল যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছে। গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে, কিন্তু কোনও প্রধানমন্ত্রী পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। গত সপ্তাহেই পাঁচ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে, তাঁদেরও রেহাই মেলেনি বিক্ষোভকারীদের হাতে।

‘সেপ্টেম্বর বিপ্লব’-এর অভিঘাতে ভেঙেচুরে পড়া নেপাল এখন ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশজুড়ে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এটি কি সত্যিই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, নাকি বিদেশি শক্তির পরিচালিত এক পরিকল্পিত ক্ষমতার পালাবদল?