আজকাল ওয়েবডেস্ক: গাজায় যুদ্ধবিরতির পর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীতে পাকিস্তান সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তিনি বলেন, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার সংসদ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে পরামর্শ করবে।
খাজা আসিফ পাকিস্তানের জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যদি পাকিস্তানকে এতে অংশ নিতে হয়, তবে আমি মনে করি এটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হবে। আমরা এতে অংশগ্রহণ করতে পেরে গর্বিত হব।” চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়, যা প্রায় দুই বছর ধরে চলা সংঘাতের অবসান ঘটায়।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, হামাসকে তাদের অস্ত্র জমা দিতে হবে এবং ইজরায়েলি বন্দিদের ও নিহতদের দেহাবশেষ ফেরত দিতে হবে। এছাড়া গাজায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বা “স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স” গঠনের প্রস্তাবও চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাহিনীতে সেনা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়নি। অনেক দেশ বলেছে, বাহিনীর কার্যপরিধি ও দায়িত্ব সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার পরই তারা সিদ্ধান্ত নেবে।
গাজায় সেনা পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশের ঘটনাটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দৃশ্যমানভাবে উন্নত হয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। তারা ট্রাম্পের প্রশংসা করেন এ বছরের মে মাসে সংঘটিত ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত সংঘাতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর ভূমিকার জন্য। এরপর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে শরিফ ও মুনিরকে স্বাগত জানান এবং উভয় নেতার প্রশংসা করেন।
এদিকে, মঙ্গলবার (স্থানীয় সময়) ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাফাহ এলাকায় হামাসের বিরুদ্ধে “শক্তিশালী হামলা” চালানোর নির্দেশ দেন। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর এই অভিযানে অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে, এবং আরও বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
ইজরায়েলি সরকারের এক মুখপাত্র অভিযোগ করেছেন যে হামাস ভুলভাবে এক ইজরায়েলি বন্দিদের দেহাবশেষ শনাক্ত করেছে এবং “মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে।” তবে হামাস এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে, ইজরায়েলের দুই বছরের দীর্ঘ আক্রমণে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসের কারণে বহু মৃতদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে, এবং তারা সেগুলি উদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে যত দ্রুত সম্ভব ইজরায়েলি বন্দিদের দেহাবশেষ শনাক্ত করে হস্তান্তর করা হবে।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬৮,৫০০-র বেশি প্যালেস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ এই আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী মিশনে নতুন মাত্রা আনতে পারে, যদিও ইজরায়েল এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট করেনি কোন কোন দেশের সেনা বাহিনীকে তারা গ্রহণযোগ্য মনে করবে।
যদিও এই প্রসঙ্গে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়েছেন যে গাজায় যুদ্ধোত্তর শান্তি নিশ্চিত করতে পরিকল্পিত আন্তর্জাতিক বাহিনীর ক্ষেত্রে কোন কোন বিদেশি দেশ অংশ নেবে, সেই সিদ্ধান্ত ইজরায়েলই নেবে। যুক্তরাষ্ট্রও এই অবস্থানকে সমর্থন করেছে বলে নেতানিয়াহু তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠকে উল্লেখ করেন।
নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা আমাদের নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণে আছি। আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিষয়ে আমরা স্পষ্ট করেছি—কোন বাহিনী আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, তা ইজরায়েলই নির্ধারণ করবে। আমরা এইভাবেই কাজ করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব।” তিনি আরও জানান, “এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও গ্রহণযোগ্য, এবং তাদের শীর্ষ প্রতিনিধিরাও গত কয়েকদিনে তা পরিষ্কার করেছেন।”
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির পর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা চলছে। তবে এখনও স্পষ্ট নয় কোন কোন আরব বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এই বাহিনীতে সেনা পাঠাতে আগ্রহী হবে। সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে মিশর, ইন্দোনেশিয়া ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলির নাম শোনা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে মার্কিন সেনা গাজায় পাঠানো হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যিনি বর্তমানে ইজরায়েল সফরে রয়েছেন, বলেছেন, “আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে এমন দেশগুলিকেই বেছে নিতে হবে, যাদের উপস্থিতিতে ইজরায়েল স্বচ্ছন্দ বোধ করে।”
তবে রুবিও তুরস্কের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। এর আগে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনীর গাজায় কোনও ভূমিকা রাখায় তিনি আপত্তি জানাবেন। একসময় উষ্ণ সম্পর্ক থাকা তুরস্ক ও ইজরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের পর সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ইজরায়েলের বিধ্বংসী বিমান ও স্থল অভিযানকে “অমানবিক” বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন।
মার্কো রুবিও আরও জানান, গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা ইজরায়েল ও তার অংশীদার দেশগুলির মধ্যেই নির্ধারিত হবে—হামাস এতে কোনোভাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব বা আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে গাজায় বহুজাতিক বাহিনী অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করছে এবং এই নিয়ে কাতারে আলোচনা নির্ধারিত হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন চায় আরব দেশগুলি এই বাহিনীতে সেনা ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিক। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো আরব রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়নি।
অক্টোবর ১০ তারিখে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির অধীনে হামাসকে ইজরায়েলি বন্দিদের দেহাবশেষ ফেরত দিতে বলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ইজরায়েল ১৯৫ জন প্যালেস্তিনিয়ানের মৃতদেহ ফেরত দিয়েছে, আর হামাস ১৮ জন ইজরায়েলি বন্দির দেহাবশেষ হস্তান্তর করেছে বলে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে। ইজরায়েল সম্মত হয়েছে, প্রতি এক ইজরায়েলি বন্দির দেহাবশেষের বিনিময়ে ১৫ জন প্যালেস্তিনিয়ানের মৃতদেহ ফেরত দেবে।
শনিবার ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল-এ সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, তিনি “খুব ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছেন” যাতে হামাস আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আরও দেহাবশেষ ফেরত দেয়। তিনি লেখেন, “কিছু দেহাবশেষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে, তবে অনেকগুলিই তারা এখনই ফেরত দিতে পারে, কিন্তু কোনো কারণে তা করছে না।”
শনিবার রাতে ইজরায়েলি বাহিনী গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে বিমান হামলা চালায়। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, হামলাটি প্যালেস্তিনি ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছিল। তবে ইসলামিক জিহাদ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
 
 হামাস এই হামলাকে যুদ্ধবিরতির “স্পষ্ট লঙ্ঘন” বলে নিন্দা করেছে এবং অভিযোগ করেছে যে নেতানিয়াহু ট্রাম্পের শান্তি উদ্যোগকে ক্ষুন্ন  করছেন।
গত ১৯ অক্টোবরও একই এলাকায় হামলা হয়েছিল, যেখানে অন্তত ৩৬ জন প্যালেস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিল।
 
 গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও উত্তেজনা অব্যাহত। হামাসের দেহাবশেষ অনুসন্ধান অভিযান, ইজরায়েলি পাল্টা হামলা ও আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন নিয়ে দ্বিধা—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সম্ভাবনা এখনও অনিশ্চিত রয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইজরায়েলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত একক সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং তুরস্ককে বাদ দেওয়ার মনোভাব ভবিষ্যতে এই আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
