আজকাল ওয়েবডেস্ক: বজ্রপাত শুধু গ্রীষ্মকালীন ঝড়ে আকাশ জুড়ে নাটকীয় আলোর ঝলক নয়। এটি আসলে এক বিস্ময়কর বায়ু দূষণের উৎসও বটে। প্রতিটি বজ্রপাতের সময় নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি হয়। এটি এমন দূষণকারী গ্যাস যা গাড়ির এক্সহস্ট থেকেও নির্গত হয়। এই গ্যাসগুলো বায়ুর গুণমানকে প্রভাবিত করে এবং জলবায়ুকে এমনভাবে বদলে দেয় যা বিজ্ঞানীরা এখনই প্রথমবারের মতো সরাসরি পর্যবেক্ষণ শুরু করেছেন।


২২,০০০ মাইল উঁচু থেকে পৃথিবীকে নজরদারি করছে নাসার শক্তিশালী স্যাটেলাইট টেম্পো। সাধারণত এটি প্রতি ঘণ্টায় একবার করে বায়ু দূষণের তথ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু ২০২৫ সালের জুন মাসের শেষদিকে কয়েকদিনের জন্য বিশেষ এক পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। সেই সময় গবেষকরা টেম্পোকে প্রতি ১০ মিনিটে একবার করে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল জুড়ে চলা বজ্রঝড়গুলোকে সরাসরি অনুসরণ করা যায়। এতে বিজ্ঞানীরা ঝড়ের ঘটনা কেবল পরবর্তী সময়ে নয়, ঘটার সময়ই ধরতে সক্ষম হন।

আরও পড়ুন: পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার রহস্য কী, উঠে এল অবাক করা তথ্য


প্রফেসর কেনেথ পিকারিং বলেন, “এই ধরনের গবেষণা এত ঘন সময় ব্যবধানে এই প্রথম করা হল। বজ্রঝড় দ্রুত গড়ে ওঠে, তীব্র হয়, আবার এক ঘণ্টার মধ্যেই মিলিয়ে যায়। ছোট ছোট সময় ব্যবধানের এই পর্যবেক্ষণ আমাদের ঝড়ের প্রকৃত চিত্র বুঝতে সাহায্য করে।” গবেষক ডেল অ্যালেন জানান, এই পরীক্ষার সময় NOAA-র জিওস্টেশনারি লাইটনিং ম্যাপার স্যাটেলাইট যন্ত্রের মাধ্যমে কতগুলো বজ্রপাত ঘটছে তা গণনা করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, “এতে আমরা নির্ণয় করতে পারি প্রতিটি বজ্রপাত কতটুকু নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড তৈরি করছে এবং সেই গ্যাস কতক্ষণ বায়ুমণ্ডলে টিকে থাকে।”


অ্যালেনের মতে, এই তথ্য জলবায়ু মডেল উন্নত করতে সাহায্য করবে এবং বজ্রপাত কীভাবে আমাদের শ্বাস নেওয়া বাতাসকে প্রভাবিত করে তা ভালোভাবে বুঝতে সহায়ক হবে। নাইট্রোজেন অণুর টুকরোগুলো পুনরায় যুক্ত হয়ে নাইট্রোজেন অক্সাইডে রূপ নেয়। যেমন গ্যাস সাধারণত পেট্রোল বা ডিজেল পোড়ালে তৈরি হয়। এই গ্যাসগুলো ওজোন তৈরির প্রধান চালিকা শক্তি, আর ওজোন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বায়ু দূষক।


পিকারিং জানান, “বিশ্বজুড়ে মোট নাইট্রোজেন অক্সাইডের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বজ্রপাত থেকে আসে। মানুষের তৈরি দূষণ অবশ্য অনেক বেশি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বজ্রপাত এই গ্যাসগুলোকে অনেক উঁচু স্তরে ছেড়ে দেয়, যেখানে ওজোন উৎপাদন আরও কার্যকরভাবে ঘটে।”
যেখানে গাড়ির ধোঁয়া মাটির কাছাকাছি বাতাস দূষিত করে, সেখানে বজ্রপাত-সৃষ্ট দূষণ হয় অনেক উঁচুতে। এর ফলে সৃষ্ট ওজোনের উষ্ণায়ন প্রভাবও অনেক বেশি হয়। তবে এই দূষণ কখনও কখনও বাতাসের প্রবাহে ভেসে নেমে আসে মাটির কাছাকাছি স্তরে। ফলে শত শত মাইল দূরের বায়ুগুণমানেও প্রভাব ফেলে। গ্রীষ্মকালে এটি বেশি হয়, কারণ তখন উচ্চ তাপমাত্রা ওজোন উৎপাদন ত্বরান্বিত করে।


তবে সবটাই খারাপ খবর নয়। বজ্রপাত কিছু উপকারী জিনিসও তৈরি করে: হাইড্রক্সিল র্যা ডিক্যাল। এগুলো ক্ষুদ্র অণু, যেগুলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো কাজ করে, ক্ষতিকর গ্যাস ভেঙে ফেলে যেমন মিথেন, একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। অ্যালেন বলেন, “আমাদের পূর্ববর্তী গবেষণা অনুযায়ী প্রতিটি বজ্রপাত গড়ে প্রায় ২৫০ মোল নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি করে। তবে এই সংখ্যা অনিশ্চিত এবং বজ্রপাতভেদে দশগুণ পর্যন্ত তারতম্য হতে পারে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা বিশ্বাস করি, যখন ঝড় তীব্রতর হয় তখন বজ্রপাতগুলো সংক্ষিপ্ত হয় এবং প্রতি বজ্রপাত কম নাইট্রোজেন অক্সাইড উৎপন্ন করে। এই গবেষণা আমাদের তা প্রমাণের সুযোগ দেবে।”


বজ্রঝড়ে যা ঘটে, তা বজ্রঝড়েই থেকে যায় না। বজ্রপাতের গ্যাসগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উপরিস্তরের বাতাস তাদের অনেক দূরে নিয়ে যায়, কখনো মাটির কাছেও নামিয়ে আনে। পিকারিং বলেন, “কলোরাডোর মতো পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারীদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, কারণ এসব স্থানে বজ্রপাত স্থানীয় ওজোন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এতে আবহাওয়াবিদরা ঝড় চলাকালীন ও পরে বায়ুগুণমান পূর্বাভাস আরও ভালোভাবে দিতে পারবেন।”


অ্যালেনের মতে, এই স্যাটেলাইট তথ্য গবেষকদের জন্য মৌলিক ডেটা সরবরাহ করছে, যার মাধ্যমে বোঝা যাবে প্রতিটি বজ্রপাত আসলে কতটা দূষণ ছাড়ে এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে এর ভারসাম্য কীভাবে বদলাতে পারে। তিনি বলেন, “আমরা এই উচ্চ-ঘনত্বের তথ্য ব্যবহার করে বর্তমান জলবায়ু মডেলের বড় বড় অনিশ্চয়তা দূর করতে চাই। ভালো তথ্য মানে ভালো পূর্বাভাস, আর তার মানে আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দূষণ থেকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করার সুযোগ।”