আজকাল ওয়েবডেস্ক:  জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ভাষণ রাখতে গিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান স্পষ্ট জানালেন—তার দেশ কখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এটা কোনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা যুদ্ধের ভয় নয়, বরং ধর্মীয় বিশ্বাস এবং দেশের সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশই ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্র থেকে বিরত রাখে।

পেজেশকিয়ান প্রশ্ন তোলেন, যেসব দেশ ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ তুলছে, তাদের হাতেই বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক ভাণ্ডার রয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বারবার পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT) লঙ্ঘন করে নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। ইরানি প্রেসিডেন্ট এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বরাবরই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে।

তিনি বিশেষভাবে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—এই তিন ইউরোপীয় দেশকে (E3) নিশানা করেন। পেজেশকিয়ানের মতে, এই দেশগুলির “স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম” চালু করে ইরানের ওপর সব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ ছিল নিছক ‘অবিশ্বাস ও প্রতারণা’। তিনি অভিযোগ করেন, ইউরোপীয়রা নিজেদের স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা পূরণের জন্য ইরানকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।

আরও পড়ুন: প্যালেস্টাইনকে একযোগে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ব্রিটেন-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া! বিশ্ব রাজনীতিতে বড় মোড়

পেজেশকিয়ান জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের যৌথ সামরিক আক্রমণকে আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেন। তার ভাষায়, “এটি ছিল এক ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা, যখন ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা চালাচ্ছিল।” তিনি আরও বলেন, এই আক্রমণে ইরানের বহু কমান্ডার, সাধারণ মানুষ, নারী-শিশু, বিজ্ঞানী এবং মেধাবী নাগরিক নিহত হয়েছেন। এর ফলে শুধু আঞ্চলিক শান্তির সম্ভাবনা নয়, আন্তর্জাতিক আস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইরানি প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, গাজায় গণহত্যা ও বর্ণবৈষম্য চালিয়ে এবং লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও কাতারসহ একাধিক দেশে আক্রমণ চালিয়ে ইজরায়েল এখন প্রকাশ্যে “গ্রেটার ইজরায়েল”–এর ধারণা প্রচার করছে। তিনি একে “বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক কল্পনা” আখ্যা দিয়ে সতর্ক করেন যে, এই আগ্রাসন যদি মোকাবিলা না করা হয়, তবে তা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করতে পারে।

পেজেশকিয়ানের মতে, ইজরায়েল এখন আর কোনো ধরনের শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা চায় না, বরং কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অঞ্চল দখলে রাখতে চাইছে। ভাষণে পেজেশকিয়ান আবারও ইরানের দীর্ঘদিনের প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেন—মধ্যপ্রাচ্যকে সব ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা। পাশাপাশি তিনি একটি সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ও উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানান, যেখানে প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব হবে অলোচনাতীত নীতি।

তিনি বলেন, এই কাঠামোর মাধ্যমে মানব মর্যাদা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, যৌথ নিরাপত্তা ও পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করা সম্ভব। পাশাপাশি পরিকাঠামো, আধুনিক বিজ্ঞান, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবেশ রক্ষায় যৌথ বিনিয়োগের কথাও উল্লেখ করেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটি একটি “বিস্তৃত আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা” গড়ে তোলার প্রথম ধাপ।

পেজেশকিয়ান ভাষণের শেষে বলেন, “সত্যিকার নিরাপত্তা কখনও শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে আসে না, বরং আস্থা তৈরি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আঞ্চলিক সংহতি এবং আন্তর্জাতিক আইনসম্মত বহুপাক্ষিকতাই এর ভিত্তি।”  সামগ্রিকভাবে, জাতিসংঘ মঞ্চে ইরানি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ছিল পশ্চিমী  দ্বিচারিতা, মার্কিন-ইজরায়েলি আগ্রাসন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।