আজকাল ওয়েবডেস্ক: গভীর সমুদ্র খননের নেতিবাচক প্রভাব আর কেবল সমুদ্রতলেই সীমাবদ্ধ নয়। বিতর্কিত এই শিল্প এখন সাগরের জলস্তরেও সমস্যা তৈরি করছে। প্রভাব পৌঁছে যাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশ থেকে শত শত ফুট উপরে। নতুন এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখিয়েছে, খননযান থেকে জলে ফেলা বর্জ্য পৃথিবীর যে কোনও মহাসাগরেরই জটিল খাদ্যজালকে সরাসরি ব্যাহত করতে পারে।


হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়–মানোয়ার গবেষকরা প্রথমবারের মতো দেখিয়েছেন যে Clarion-Clipperton Zone (CCZ) অঞ্চলের “টুইলাইট জোনে” বা মধ্য-অন্ধকার স্তরে ফেলা খননবর্জ্য শত শত ফুট উঁচু পর্যন্ত জৈবচক্রকে নাড়া দিতে পারে। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫০ থেকে ৪,৯০০ ফুট গভীরতায় থাকা অর্ধেকেরও বেশি জুপ্ল্যাঙ্কটন এবং প্রায় ৬০ শতাংশ মাইক্রোনেকটন সরাসরি এই বর্জ্য প্লুমের সংস্পর্শে আসে।


কীভাবে তৈরি হয় এই ক্ষতিকর বর্জ্য?
গভীর সমুদ্র খননের সময় সাগরের তলদেশ থেকে পলিমাটি, সমুদ্রের জল এবং গুঁড়ো করা নডিউল ভেসে ওঠে পাইপের মাধ্যমে। খনিজ নডিউলগুলো আলাদা করে বাজারজাত করা হয়, আর অবশিষ্ট বর্জ্য মিশ্রণ—যাকে “স্লারি” বলা হয়—পুনরায় সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক অপারেটর প্রস্তাব করেছেন যে এই বর্জ্য মাঝজলে ফেলা হলে সমুদ্রতল ঢেকে যাওয়ার ঝুঁকি কমবে। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, এই সিদ্ধান্ত উল্টো ফল দিতে পারে।


২০২২ সালে CCZ-এ পরিচালিত এক খনন পরীক্ষার সময় গবেষকেরা দেখেন, খননবর্জ্য থেকে তৈরি প্লুমের কণায় অ্যামিনো অ্যাসিডের মাত্রা প্রাকৃতিক পচা জৈব কণার তুলনায় অনেক কম। অথচ এই “মেরিন স্নো”—আসলে উপরের স্তর থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসা পুষ্টিকণা—হল জুপ্ল্যাঙ্কটন ও মাইক্রোনেকটনের প্রধান খাদ্য। সহজ ভাষায়, জলের প্রাণীদের পাতে পুষ্টিকর খাবারের বদলে ঢুকছে “ফাঁকা ক্যালোরি।” ইতিমধ্যেই সীমিত খাবারে বেঁচে থাকা ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোর জন্য এই পরিবর্তন বড় ধাক্কা।


জুপ্ল্যাঙ্কটনের উপর নির্ভর করে মাইক্রোনেকটন—ক্ষুদ্র মাছ, স্কুইড, চিংড়ি এবং অন্যান্য সাঁতারু প্রজাতি। এই প্রাণীরা আবার বড় সামুদ্রিক মাছ, টুনা, সামুদ্রিক পাখি এবং ডলফিন-তিমির মতো প্রাণীদের মূল খাদ্য। ফলে মাঝজলের পুষ্টিহীনতা সরাসরি উপরের স্তরের খাদ্যচক্রকে নাড়িয়ে দেয়।


টুইলাইট জোন পৃথিবীর অন্যতম ঘন জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। এখানে অন্ধকার ও স্বল্প খাদ্যের পরিবেশে ক্রিল, ল্যান্টার্নফিশ, সাইফোনোফোর এবং জেলিফিশের মতো শিকারি প্রাণী অভিযোজিত হয়ে বেঁচে থাকে। এই স্তরের বহু প্রাণী প্রতিদিন রাতের বেলায় উপরের দিকে উঠে খাদ্য সংগ্রহ করে আবার ভোরে নিচে নেমে আসে—পৃথিবীর বৃহত্তম দৈনিক প্রাণী-অভিযান এটি। এই চলাচলের মাধ্যমেই কার্বন উপরের স্তর থেকে গভীরে সঞ্চালিত হয়, যা জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে।


প্রাকৃতিক মেরিন স্নোর পরিবর্তে যখন উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে পুষ্টিহীন বর্জ্যকণা, তখন প্রাণীদের খাদ্যমান নেমে যায়, যদিও তারা নিজেদের অবস্থান বদলায় না। গবেষকরা বলছেন, “পুষ্টিকর কণার বদলে যদি ফাঁপা, পুষ্টিহীন কণা ঢুকে পড়ে, তবে বৃদ্ধি, বংশবিস্তারের ক্ষমতা এবং বেঁচে থাকার হার কমতে বাধ্য।”


যেহেতু মাইক্রোনেকটন বহু বাণিজ্যিক মাছ এবং সামুদ্রিক পাখি-স্তন্যপায়ীর প্রধান শিকার, তাই গভীর সমুদ্রের সামান্য ক্ষতিও উপকূলের মাছধরা, খাদ্যচক্র এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণা বলছে, দূরবর্তী সমুদ্রেও ক্ষুদ্র ক্ষতি পরবর্তীতে বৃহৎ পরিবেশগত সংকট তৈরি করতে পারে। গভীর সমুদ্র খনন তাই শুধু খনিজ আহরণের প্রশ্ন নয়—এটি সমগ্র সমুদ্রজীবনের ভবিষ্যতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।