আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্ব আজ একাধিক রাজনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। অপ্রতিরোধ্য হারে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ও বৈষম্যের বৃদ্ধি উন্নয়নের অর্জনগুলিকে ক্ষয় করছে, সামাজিক বিভাজন বাড়াচ্ছে এবং অসন্তোষ ও হিংসার জন্ম দিচ্ছে। ‘ইন্ডিকেটরস অব গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে নির্ধারিত ১.৫° সেলসিয়াস উষ্ণতার সীমা লঙ্ঘনের আর মাত্র তিন বছরের অপেক্ষা। এই সীমা অতিক্রম করলে পৃথিবীর জলবায়ুগত ভারসাম্যে অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি হবে।
এই বহুমাত্রিক সংকট একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে সঙ্কোচন সৃষ্টি করছে। ধনী দেশগুলির কাছ থেকে পর্যাপ্ত জলবায়ু ফান্ডিংয়ের অভাবে বহু উন্নয়নশীল দেশ আবারও জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। একই সঙ্গে, অন্যায্য ঋণব্যবস্থা দরিদ্র দেশগুলিকে চিরস্থায়ী আর্থিক সঙ্কটে আবদ্ধ রেখেছে। উচ্চ সুদের হারে ডলার-নির্ভর স্বল্পমেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে তারা তাদের নিজস্ব উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না। ধনী দেশগুলো অবৈধ অর্থপ্রবাহ বন্ধ করা বা বহুজাতিক সংস্থা ও কোটিপতিদের ওপর আন্তর্জাতিক কর আরোপের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক। ফলে নিম্নআয়ের দেশগুলির রাজস্ব আয় বাড়ানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা গণতান্ত্রিক সংকটের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে যুক্ত। যখন সম্পদ কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন রাজনৈতিক অসন্তোষ বাড়তে বাধ্য। পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোতে দক্ষিণপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলির উত্থান সেই প্রবণতারই প্রতিফলন।
বিশ্বের এই বহুমাত্রিক সংকট কাটাতে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই এখন সবচেয়ে জরুরি। জাতীয় পর্যায়ে নাগরিকদের উন্নয়ন নীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জি-২০, জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন ও ব্রেটন উডস সংস্থাগুলিকে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে, যাতে তারা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বৈধতা ফিরে পায়। এতদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত উন্নত বিশ্বের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
অনেক উদাহরণই দেখায়, কীভাবে তথাকথিত বহুপাক্ষিকতা বিশ্বে বৈষম্য পুনরুৎপাদন করেছে। উন্নত দেশগুলি যে জলবায়ু তহবিল দিচ্ছে, তার বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ঋণের নিশ্চয়তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে—ফলে দরিদ্র দেশগুলির ঋণের বোঝা আরও বাড়ছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, রেটিং এজেন্সি ও আইএমএফের কঠোর শর্তাবলী সরকারগুলিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিনিয়োগ থেকে বিরত রাখছে। আর তথাকথিত “সবুজ রূপান্তর”–এর নামে যে বেসরকারি খাতনির্ভর নীতি নেওয়া হচ্ছে, তা মূলত শ্রমিক শ্রেণির অনিশ্চয়তা ও দারিদ্র্যকেই আরও বাড়াচ্ছে।
এই বিশ্ব পুঁজিনির্ভর নীতিগুলির ফলে “অতিরিক্ত মানুষ” বা “surplus population”–এর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকরা, খনি বন্ধ হওয়ায় বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়, এবং খাদ্য ও জ্বালানির দামবৃদ্ধিতে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত পরিবারগুলোই আজ সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
এই বাস্তবতায় কী করা যায়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দক্ষিণ গোলার্ধের বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন ও এনজিও আগামী জি-২০ সম্মেলনের প্রাক্কালে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হতে চলা “পিপলস সামিট ফর গ্লোবাল ইকনমিক জাস্টিস”–এ একত্রিত হবে। “আমরাই ৯৯%” শিরোনামে এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য হবে পুঁজিবাদী “শত্রুতার সমাজ”-এর বিকল্প নির্মাণ এবং ন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথে একটি আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা।
সম্মেলনের অন্যতম প্রস্তাবিত উদ্যোগ হলো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর সহযোগিতা কাঠামোর আওতায় অতিধনী ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলির ওপর বিশ্ব সম্পদ কর আরোপ। এই কর ব্যবস্থা কেবল আর্থিক ও ঋণ সংকটের মোকাবিলার জন্য নয়, বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য কমানোর জন্যও অপরিহার্য বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়াও আলোচনায় গুরুত্ব পাবে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী সরকারি জলবায়ু তহবিলের পরিধি বৃদ্ধি, প্রবেশাধিকার সহজতর করা ও মূল্যসাশ্রয়ী করা–র বিষয়টি। কারণ উন্নত দেশগুলির শিল্পোন্নয়নের জন্য যে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পণ্য উন্নয়নশীল দেশগুলি সরবরাহ করে, তার বিনিময়ে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা সেই দেশগুলিতে ফিরে আসতে হবে। এর মধ্য দিয়েই ক্ষতিপূরণ ও টেকসই উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জি-২০ সভাপতিত্ব যেহেতু “সংহতি, সমতা ও স্থায়িত্ব” নীতিতে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাই এই সম্মেলনের উদ্যোগকে দেখা হচ্ছে এক ধরনের নৈতিক মেরামতির প্রকল্প হিসেবে—যেখানে পৃথিবীকে এক অভিন্ন গৃহ হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং সব দেশের পারস্পরিক নির্ভরতা ও দুর্বলতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বে অর্থনৈতিক অবিচার ও গণতান্ত্রিক ক্ষয়ের ঝুঁকি কমাতে হলে, এই মুহূর্তে প্রয়োজন নিচু স্তর থেকে সংগঠিত রাজনৈতিক কর্মসূচি, ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর ও সম্পদের ভাগাভাগি। তবে এই আন্দোলনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠবে না—তাদের গঠন, সমন্বয় ও অর্থায়ন প্রয়োজন। নাগরিক ও সামাজিক আন্দোলনগুলিকে এনজিও নির্ভর পুরোনো কাঠামো পেরিয়ে সহনশীলতা ও ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়নের নতুন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
এই নতুন উদ্যোগের উদ্দেশ্য কেবল টেকসই উন্নয়ন নয়, বরং মানব মর্যাদা, পরিবেশের ভারসাম্য ও গণতান্ত্রিক ন্যায়বোধ পুনঃস্থাপনের এক সামগ্রিক লড়াই।
