আজকাল ওয়েবডেস্ক: সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা কর্মজীবন। তারই মধ্যে গঙ্গারামের মনে বাসা বেঁধেছে এক অদ্ভুত আতঙ্ক। তাঁর স্থির বিশ্বাস, অফিসের সহকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র করে চলেছেন। সামান্য হাসি-ঠাট্টা বা নিচু স্বরে কথোপকথন শুনলেই তাঁর মনে হয়, সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তিনিই। অন্য সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব থেকে থেকে অফিসের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করা- সবই এক গভীর চক্রান্তের অংশ বলে তাঁর ধারণা।
গঙ্গারামবাবু একা নন। তাঁর এই অবস্থাও বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এমনই অসংখ্য গঙ্গারাম রয়েছেন আমাদের চারপাশে। মনোবিদদের মতে, এই ধরনের ভাবনা গুরুতর মানসিক সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কর্মক্ষেত্রের স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা এবং মানসিক রোগের মধ্যেকার সূক্ষ্ম সীমারেখাটি কোথায়? বিজ্ঞাত বিজ্ঞান জার্নাল পাব মেডের তথ্য জানাচ্ছে, পেশাদারী জীবনে প্রতিযোগিতা থাকবেই। কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি কোনও বাস্তব প্রমাণ ছাড়াই অটলভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, সকলেই তাঁর ক্ষতি করতে চাইছে এবং এই বিশ্বাস তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে, তখন বিষয়টি আর সাধারণ উদ্বেগের পর্যায়ে থাকে না। এই অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘পারসিকিউটরি ডেলিউশন’ বা ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাস বলা হয়।
এই ধরনের মানসিক অবস্থার পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে মনোবিদরা মূলত দু’টি প্রধান সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করছেন।
১। ডেলিউশনাল ডিসঅর্ডার (পারসিকিউটরি টাইপ): এটি এক ধরনের মানসিক রোগ, যেখানে রোগীর মধ্যে একটি বা একাধিক ভ্রান্ত অথচ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়। ‘পারসিকিউটরি’ বা নিপীড়নমূলক ধরনে রোগী মনে করেন, তাঁকে কেউ অনুসরণ করছে, তাঁর ক্ষতি করার চক্রান্ত করছে বা তাঁকে অপমান করার চেষ্টা করছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে কিন্তু এঁরা আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক আচরণ করেন। ফলে বাইরে থেকে দেখে এঁদের অসুস্থতা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।
২। প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছোটবেলা থেকেই এক ধরনের সন্দেহবাতিক মানসিকতা নিয়ে বড় হন। এঁরা সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না এবং অন্যের সাধারণ কাজের মধ্যেও গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত খুঁজে পান। কর্মক্ষেত্রের চাপ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ এই সুপ্ত মানসিকতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এঁরা সহকর্মীদের সামান্য সৌজন্যমূলক আচরণকেও সন্দেহের চোখে দেখেন।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর একমাত্র সাদা জিরাফ কোথায় থাকে? কার ভয়ে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা হয় তাকে? জানলে চোখে জল আসবে
কেন বাড়ছে এই প্রবণতা?
মনোবিদদের মতে, আধুনিক কর্মজীবনের অসহনীয় চাপ, নিরাপত্তাহীনতা, কাজের প্রতি অতিরিক্ত দায়বদ্ধতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এই ধরনের মানসিকতাকে উস্কে দিচ্ছে। এছাড়া, অতীতে কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত জীবনে প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতাও মনে গভীর অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে। অনেক সময়েই এই লক্ষণগুলি দিনের পর দিন বাড়তে থাকে এবং একসময় তা ব্যক্তির পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
প্রতিকারের উপায় কী?
বিশেষজ্ঞদের সাফ কথা, এই অবস্থাকে অবহেলা করা চলবে না। পরিবারের সদস্য বা কাছের বন্ধুদের উচিত, আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভরসা দিয়ে কোনও মনোচিকিৎসক বা মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া। সঠিক কাউন্সেলিং, কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি এবং প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কর্মক্ষেত্রেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং সচেতনতা প্রসারের প্রয়োজন রয়েছে।