বায়ুদূষণ থেকে বাড়ছে ডায়াবেটিসের সমস্যা, জানিয়ে দিলেন চিকিৎসকরা
সুমিত চক্রবর্তী
শনিবার, 11 অক্টোবর 2025
1
12
বায়ু দূষণের প্রভাব এখন ফুসফুসের গণ্ডি পেরিয়ে শরীরের গভীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমবর্ধমান প্রমাণ বলছে, দূষিত বাতাস শুধু হৃদরোগ ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার জন্য নয়, বরং বিপাকীয় ব্যাধি—যেমন ইনসুলিন প্রতিরোধ ও টাইপ–২ ডায়াবেটিসের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
2
12
সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের একটি নতুন গবেষণা এই সম্পর্ককে আরও তীক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তারা দেখিয়েছেন, সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার শরীরের বিপাকীয় “ফার্নেস” বা জ্বালানি পোড়ানোর পদ্ধতিকে নতুনভাবে প্রোগ্রাম করে দিতে পারে।
3
12
PM2.5 হল বাতাসে ভাসমান এমন অতিক্ষুদ্র কণিকা—যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারেরও কম। এগুলো ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহে পৌঁছাতে পারে। শহরের মতো দীর্ঘমেয়াদি দূষণের প্রভাব অনুকরণ করতে গবেষকরা ইঁদুরদের দুটি দলে ভাগ করেন—একদলকে পরিশোধিত বাতাসে, আরেকদলকে কেন্দ্রীভূত PM2.5–সমৃদ্ধ বাতাসে রাখা হয়। এই পরীক্ষা চলে ২৪ সপ্তাহ ধরে, প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা, সপ্তাহে পাঁচ দিন।
4
12
গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘ব্রাউন ফ্যাট’ বা বাদামী চর্বি। সাদা চর্বির কাজ যেখানে শক্তি সঞ্চয় করা, সেখানে ব্রাউন ফ্যাট শক্তি পুড়িয়ে তাপ উৎপন্ন করে। এটি রক্তে শর্করা, লিপিড ও সামগ্রিক শক্তির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। ফলে এর কার্যকারিতায় সামান্য পরিবর্তনও বিপাকীয় ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
5
12
প্রায় পাঁচ মাস পর ফলাফল স্পষ্ট হয়। দূষিত বাতাসে থাকা ইঁদুরদের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমে যায়, এবং তাদের ব্রাউন ফ্যাটে এমন পরিবর্তন দেখা যায় যা একধরনের ‘অলস’ বিপাকীয় ইঞ্জিনের ইঙ্গিত দেয়। কেন এমন হচ্ছে তা জানতে গবেষকরা ব্রাউন ফ্যাটের জিন–নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া পরীক্ষা করেন। দেখা যায়, সেখানে ব্যাপক এপিজেনেটিক পরিবর্তন ঘটেছে—অর্থাৎ DNA–এর মূল কোড না বদলে কোন জিন সক্রিয় হবে বা হবে না, সেই নিয়ন্ত্রণের ধরন বদলে গেছে।
6
12
DNA মিথাইলেশন প্যাটার্নে বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। ক্রোমাটিন—যা DNA–কে ঘিরে রাখে এবং জিনে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করে—তা এমনভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে যাতে তাপ উৎপাদন ও লিপিড ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
7
12
এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম, HDAC9 এবং KDM2B, মূল ভূমিকায় ছিল। এরা হিসটোন প্রোটিনে রাসায়নিক ট্যাগ যোগ–বিয়োগ করে জিন সক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণ করে। দূষিত বাতাসে থাকা ইঁদুরদের ব্রাউন ফ্যাটে দেখা যায়, এই এনজাইমগুলো এমনভাবে কাজ করছে যাতে হিসটোন DNA–র নির্দিষ্ট অংশে বাঁধছে এবং সক্রিয়তার সহায়ক ট্যাগগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। যখন গবেষকরা এই এনজাইমগুলোর কার্যকলাপ কৃত্রিমভাবে পরিবর্তন করেন, ব্রাউন ফ্যাট তার প্রতিক্রিয়া দেখায়—অর্থাৎ এই প্রক্রিয়াই বিপাকীয় অচলাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
8
12
গবেষণার ফলাফল দুটি স্তরে প্রয়োগযোগ্য। প্রথমত, নীতিগতভাবে—PM2.5 দূষণ কমানোর জন্য শক্তিশালী বায়ু–মানের মানদণ্ড, পরিষ্কার পরিবহন ব্যবস্থা ও অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়া মোকাবিলার উন্নত কৌশল প্রয়োজন। জনসমষ্টিগত স্তরে দূষণ কমলে বিপাকীয় রোগের ঝুঁকিও কমবে।
9
12
দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাগতভাবে—এমন ওষুধ বা থেরাপি তৈরি করা যেতে পারে যা ব্রাউন ফ্যাটের জিন প্রোগ্রাম রক্ষা করবে বা HDAC9 এবং KDM2B–এর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে। যদিও এটি দূষণ প্রতিরোধের বিকল্প নয়, তবুও উচ্চ দূষণযুক্ত পরিবেশে ক্ষতি কিছুটা কমাতে পারে।
10
12
জীবনধারার পরিবর্তন—যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও নিরাপদ ঠান্ডা পরিবেশে থাকা—ব্রাউন ফ্যাট সক্রিয় রাখতে সাহায্য করতে পারে, তবে এগুলোও পরিষ্কার বাতাসের বিকল্প নয়।
11
12
গবেষণাটি ইঁদুরের ওপর পরিচালিত হয়েছে, তাই মানুষের ক্ষেত্রে এই ফলাফল প্রয়োগের আগে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবু দীর্ঘমেয়াদি শহুরে দূষণ–সদৃশ পরিবেশে এই পরীক্ষার বাস্তবধর্মী নকশা এবং নির্দিষ্ট এনজাইম চিহ্নিতকরণ একে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
12
12
ভবিষ্যৎ গবেষণার মূল প্রশ্ন হল—দূষণ কমলে কি এই এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলো উল্টানো যায়? মানুষের ব্রাউন ফ্যাটে কি একই HDAC9 ও KDM2B স্বাক্ষর দেখা যায় আগুনের ধোঁয়া বা দীর্ঘ যাত্রার পর? আর, একাধিক দূষণ–উৎস—যেমন বাতাস, শব্দ, গরম ও মানসিক চাপ—একত্রে কীভাবে বিপাকীয় ঝুঁকি তৈরি করে?