একাই একশো! আজও। আজ তেসরা সেপ্টেম্বর ১০০-এ পা দিলেন উত্তমকুমার। তাঁর ঘাড় ঘুরিয়ে, সামান্য চোখ তুলে এক চিলতে হাসিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সিনেপর্দা। যার চলাফেরা, সংলাপ বলার ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি- সবকিছুতেই ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি। মারা যাওয়ার পর এত বছর ধরেও তিনি এখনও গেঁথে রয়েছে বাঙালির মনে। প্রায় একা হাতেই বদলে দিয়েছিলেন বাংলা ছবির অভিনয়ের ধারা। তবে বাংলার একমাত্র 'মহানায়ক'-এর অভিনীত, প্রযোজিত, পরিচালিত অজস্র ছবি থাকলেও নেই কোনও সাক্ষাৎকারে ভিডিও! যে অভিনেতার নাম উত্তমকুমার এবং গোটা দেশজুড়ে যাঁর ওরকম খ্যাতি, কেন নেই তাঁর কোনও সাক্ষাৎকারের ভিডিও? কারণ ১৯৮০ সালে ৫৪ বছর বয়সে খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন যখন তিনি প্রয়াত হন, তার বহু আগেই দেশের বিভিন্ন তারকার সাক্ষাৎকারের ভিডিও সম্প্রচার হয়ে গিয়েছে। তাহলে? সেই প্রশ্নের খোঁজেই নেমেছিল আজকাল ডট ইন। সঙ্গে এও জানার ইচ্ছে ছিল, যদি থাকত সেরকম একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিও, তাহলে কী হতো? ঠিক কতটা লাভবান হতো ভবিষ্যতের অভিনেতা-পরিচালকের পাশাপাশি ফিল্ম স্টাডিজের ছাত্র-ছাত্রী এবং অবশ্যই উত্তম-প্রেমীরা? উত্তরের সন্ধানে পরিচালক অতনু ঘোষ, সাংবাদিক অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কাছে হাজির হয়েছিলাম আমরা।
বিগত কয়েক দশক ধরে আজকাল সংবাদপত্রের বিনোদন বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন সাংবাদিক অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “মনে রাখতে হবে সেই সময়ে কিন্তু ভিডিও সাক্ষাৎকারের এত ছিল ছিল না। একমাত্র দূরদর্শন ছিল, যারা এরকম সাক্ষাৎকারের আয়োজন করতে পারত এবং নিত। তবে দূরদর্শনের তরফে উত্তমকুমারের ভিডিও সাক্ষাৎকার নেওয়ার আদৌ চেষ্টা করা হয়েছিল কি না, তা কিন্তু জানা নেই। আবার সেই অ্যাপ্রোচ করা হলেও উত্তমকুমার তাতে কতটা সাড়া দিতেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। কারণ উনি তো সেভাবে ছবি ছাড়া জনসমক্ষে আসতে চাইতেন না। তবে আমার বিশ্বাস, উত্তমকুমারের জন্য যদি বিশেষ ব্যবস্থা করা হতো, উনি আসতেন। কেননা, উত্তমবাবু তো সাক্ষাৎকার দিতেন। বাছাই করে হলেও দিতেন। পাশাপাশি, সেই সময়ে সেবাব্রত গুপ্ত, অমিতাভ চৌধুরীর মতো বড়-বড় সাংবাদিক বিনোদন জগতে বিদ্যমান, বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাই ওঁদের মাধ্যমে যদি উত্তমকুমারের এই সাক্ষাৎকারের আয়োজন করা যেত, শেষমেশ তা হতেই পারত। আর উত্তমকুমারের মতো তারকা তো কখনও বলতে পারেন না, যে আমার সাক্ষাৎকার নাও, ওমনভাবে নাও...তবে এমন সাক্ষাৎকার থাকলে লাভবান তো হতামই, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অন্তত, ওয়ান-টু-ওয়ান সাক্ষাৎকার না হলেও সাংবাদিক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সঙ্গে ওঁর একটা অনন্ত একটা রাউন্ড-টেবিল সাক্ষাৎকার থাকলেও দারুণ হত।”
সামান্য থেমে তিনি আরও বললেন, “তবে উত্তমকুমারের অডিও-ভিজ্যুয়াল সাক্ষাৎকার না থাকলেও তা যে বিরাট ক্ষতি, তা আমার মনে হয় না। কারণ ওঁর নিজের আত্মজীবনী যেমন রয়েছে, ওঁর বহু লেখা, চিঠি ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। ওঁকে নিয়ে বহু নামী সাংবাদিক, লেখক, অভিনেতা-অভিনেত্রী নানান লেখা লিখেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন। তাই উত্তমকুমারের অভিনয় ছাড়াও যে ওঁর অন্যান্য বিষয়ে একেবারেই জানা যায় না, এমনটি কিন্তু নয়। আসলে, আফসোসের তো কোনও শেষ থাকে না।”
‘ময়ূরাক্ষী’, ‘রবিবার’, ‘বিনিসুতোয়’-এর মতো একাধিক জনপ্রিয় ছবির পরিচালক অতনু ঘোষ। তাঁর পরিচালিত অধিকাংশ ছবি জনতামহলের পাশাপাশি সমালোচকমহলেও বিপুল সমাদৃত। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্র পরিচালকের কথায়, “১৯৭৪/৭৫ সাল নাগাদ কবিতা সিংহকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন উত্তমকুমার। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকের প্রশ্নগুলো ছাপা ছিল না। স্রেফ উত্তম-উত্তর। কিন্তু নায়কের জবাবগুলো থেকেই প্রশ্নের অভিমুখ পরিষ্কার। সেই সাক্ষাৎকারটিতে অভিনয় নিয়ে যেসব কথা বলেছিলেন উত্তমকুমার, তা অভূতপূর্ব! সেই সাক্ষাৎকারটি যদি এই প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পড়েন, তাঁরা যে কতটা লাভবান হবেন তা তাঁরা হয়ত নিজেও জানেন না। তাই, আমার কাছে সেটিই উত্তমের শ্রেষ্ঠ সাক্ষাৎকার।

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, উত্তমের অভিনয়ধারা থেকেই বাংলা ছবিতে জন্ম নিল শিল্পবিপ্লব। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক ছবির আকাশে জন্ম নিয়েছেন একের পর এক তারকা-অভিনেতা, যারা ক্যাজমেরার সামনে অভিনয়ের মধ্যে নতুন চিন্তার আলো জ্বালিয়ে দিলেন। যেমন আমেরিকায় মার্লন ব্র্যান্ডো, ফ্রান্সে জ্যঁ-পল বেলমন্ডো, ইতালিতে মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ানি, জাপানে তসিরো মিফুনে—কুরোসাওয়ার ছবিতে যাঁর অবিস্মরণীয় উপস্থিতি। উত্তমকুমারও থাকবেন এই তালিকায়! তাঁর অভিনয়ে ছিল না নাট্যধারার প্রভাব, ছিল না যাত্রার প্রভাব। যাকে বলে বিয়িং রিয়েল, বিয়িং ট্রুথফুল। তা সত্বেও এমন অভিনয়ের কম সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এটা শুধু আমার কথা নয়, বলেছিলেন খোদ সত্যজিৎ রায়-ও। উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পর একটি স্মরণসভায় একথা বলার পাশাপাশি একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রেও উত্তম-শীর্ষক এক লেখাতেও নিজের এই ভাবনা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। আমার এসব কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য, ওঁর এরকম অভিনয়ধারা নিয়ে তেমন কোনও গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনার জায়গা তো তৈরিই হল না। স্রেফ স্বপন মল্লিকের লেখা বই ‘মহানায়ক রিভিজিটেড’-এ উত্তমের অভিনয়ের নানান দিক নিয়ে কিছুটা গভীর আলোচনা রয়েছে।

সামান্য থেমে তিনি আরও বলে উঠলেন, “ফিরি কবিতা সিংহের নেওয়া সেই উত্তম-সাক্ষাৎকারের কথায়। প্রিন্টেই ওরকম সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন উনি, তাই সেরকম একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল সাক্ষাৎকার যদি উত্তমকুমার দিতেন... তাহলে ভাবতে পারছেন আরও কী কী সব মণি-মাণিক্যর সন্ধান আমরা আজ পেতাম! অবশ্য এসব কথা বলা খুব মুশকিল, কারণ দূরদর্শনের সঙ্গে প্রথম থেকেই দূরদর্শী কিছু মানুষ যুক্ত ছিলেন, তাই তাঁরা কি একবারের জন্যেও উত্তমকুমারকে এরম একটি সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তাব না দিয়ে ছিলেন? কে জানে! আবার প্রস্তাব পেলেও উত্তমবাবু কি রাজি হয়েছিলেন? সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। যেটা হল, তা হল আমাদের দুর্ভাগ্য! এটুকু বলতে পারি, ওঁর মাপের একজন অভিনেতার এক্সিকিউশনটা আমরা দেখতে পেয়েছি কিন্তু অ্যাপ্লিকেশনটা...মানে, অভিনয়ের পিছনে ওঁর যে মনটা, প্রস্তুতি, প্রবণতা সেই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেত, যা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকত। কারণ, একটা ব্যাপার পরিষ্কার -উত্তমকুমার অভিনয়ের ভাষাটা ভীষণ পরিষ্কার বুঝতে পারতেন। তাই তো আজও ওঁর অভিনয়ের মধ্যে যে আধুনিকতা ছিল তা দেখে চমকে উঠতে হয়। তাই এর নেপথ্যে কী কী বিষয়, তা কিছুই আমরা জানতে পারলাম না।
আমি এখানে আরও একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, ছবিতে অভিনয় নিয়ে কি আমাদের স্বচ্ছ ধারণা আজও হয়েছে? অভিনয়কে আমরা কি নিখাদ চলচ্চিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি আমরা? সম্ভবত না। কখনও সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, কখনও বা থিয়েটারের দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই না?”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। অধ্যাপনার পাশাপাশি বহু বছর ধরে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশে-বিদেশের নানান গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায়। আলোচিত বিষয়ে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, মতামত তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই ধারালো, সোজাসাপটা। “আজকালকার শিল্পীর মতো খ্যাতির কাঙাল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর মানুষ ছিলেন না উত্তমকুমার। গিরীশ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, শিশির ভাদুড়ীদের মাপের অভিনেতা ছিলেন তিনি। উত্তমকুমার একজন দুরন্ত অভিনেতা ছিলেন না, শুধুই একজন দেশের অন্যতম বড় তারকা ছিলেন না কিংবা প্রথম ভরত পুরস্কার পাওয়া শিল্পীও ছিলেন না। তাঁকে দেখে সত্যজিৎ রায় নায়ক ছবিটি লিখেছিলেন, ঠিক যেমন হলিউডে মেরিলিন মনরো-কে নিয়ে লেখা হতো! পরিষ্কার করে বলি, এমনটি মোটেও নয় যে নায়ক-এর চিত্রনাট্য লিখে সত্যজিৎ উত্তমকুমারের কথা ভেবেছিলেন। বরং উল্টোটা। কারণ এই ছবিতে এমন অনেক কিছু সংলাপ, দৃশ্য রয়েছে যা উত্তম-পরামর্শ ছাড়া হতে পারে না।
আমাদের জনপ্রিয় সংস্কৃতির অবজ্ঞার কথাও এ প্রসঙ্গে একটু বলা উচিত। তথাকথিত আর্ট ফিল্ম আমাদের সামাজিক পরিসরের চলচ্চিত্রের যে গুরুত্ব, তা কমিয়ে দিল। হঠাৎ করে বেশ কিছু পরিচালক ও সংবাদমাধ্যমের মনে হওয়া শুরু হল, শুধুই সত্যজিৎ রায়, মৃণাল দেন কিংবা ঋত্বিক ঘটক হওয়াই ছবির মানুষদের একমাত্র কাজ। ঋত্বিককেও অবশ্য পাত্তা দেওয়া হয়নি তাঁর জীবদ্দশায়। এই অপরাধের রক্ত আমাদের হাত থেকে মুছবে না।
ফিরে আসি, উত্তমকুমারের কথায়। তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় কেউ বুঝতেই পারেননি তিনি কোন মাপের অভিনেতা। তাঁর অভিনয়ের বদলে বেশি আলোচনা হয়েছে তিনি কী খান, ভেটকি মাছের ফ্রাই না কাঁটা চচ্চড়ি, কোন অভিনেত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন,আলোচিত হত তিনি দানবীর ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো, হাসি ছিল ভুবনভোলানো...আরে তিনি এসবের জন্য উত্তমকুমার হননি। তিনি মূলত ছিলেন একজন বলিষ্ঠ অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক। তিনি যে পাঠ্যপুস্তকসম শ্রম করতেন, তা নিয়ে হয় না কোনও আলোচনা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে-র গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে কী পরিমাণ ঠোঁট ও মুখের পেশির সঞ্চালনের অনুশীলন করতেন ক'জন জানেন? ওরকম দু'জন গায়ককে ধারণ করার জন্য ঠোঁটের ব্যায়াম করতেন! আজকেও সময়ে কোনও নায়ক এটা ভাবতেই পারেন না। ভাবেনও না!

উত্তমকুমার তো পর্দায় মারপিট করতেন না, নাচতেনও না খুব একটা। ওঁর যে কাঁধের ভঙ্গি, হাত নাড়ানো, ছন্দ অনুযায়ী আঙ্গুলগুলোর নাড়াচাড়া অভিনয়ের এবং ওঁর মুখের সব অভিব্যক্তি নিয়ে যদি একটা তথ্যচিত্র তৈরি হতো, তাহলে এখনকার সময়ের বহু অভিনেতাদের কাছে অভিনয়ের পাঠ্যপুস্তক হতো। তাঁরা বুঝতেন কীভাবে, কতভাবে অভিনয়ে মুখটাকে ব্যবহার করা যায়। আমরা ভেবেই নিয়েছি যেহেতু সত্যজিৎ ছাড়া এমন কোনও পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করেননি যাঁদের ছবি দেখলে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অহং স্ফীত হয়, তাই তিনি অভিনেতা নন! কারণ উত্তমকুমার তো আমাদের মতো ছিলেন। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। কোর্ট-কমিশনে কেরানির চাকরি করতেন, ইংরেজি বলতে পারেন না, কোনও বংশগৌরব ছিল না। তাঁকে সব পর্যায়ের বাঙালি কেন গুরুত্ব দেবে? আর এই যদি উত্তমকুমারের মারাত্মক বংশগৌরব থাকত, দুরন্ত বাচিকশিল্পী হতেন তাহলে দেখতেন বাঙালির মাথায় তুলে নাচা! আসলে বাঙালি মধ্যবিত্তদের তো প্রচুর অপরাধ আছে, তার মধ্যে এটা একটা লুকোনো অপরাধ। নইলে মৃণাল সেনের প্রথম ছবিতে উত্তম অভিনয় করেছিলেন, যদিও মৃণাল দেন কোনওদিনও তা স্বীকার করেননি। কিন্তু নির্মল দে-র বসু পরিবার থেকে অজয় কর হয়ে পার্থপ্রতীম চৌধুরী, পিনাকী মুখোপাধ্যায়- যাঁর সঙ্গেই হোক নিজের সেরাটা দিয়েছেন। উত্তমের সম্বন্ধে একটা কথা বলা হতো যা মেরিলিন মনরো নিয়ে বলা হতো। তাঁর কথা ভেবেই একাধিকবার ছবির গল্প-চিত্রনাট্য পাল্টানো হচ্ছে শুধু পর্দায় 'উত্তমকুমার'কে ধরে রাখার জন্য! উনি একা একটা ইন্ডাস্ট্রি টেনেছিলেন মৃত্যুশয্যায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত। যাই হোক, উত্তমের এই যে অভিনয়সৌকর্য নিয়ে ভাবা উচিত যা আমরা ভাবিনি... যা ভাবা হয়েছে রিচার্ড বার্টনের ক্ষেত্রে, মার্লন ব্র্যান্ডোর ক্ষেত্রে। এটা পাপ! এটা অপরাধ! আশা করি এখন অন্তত তা ভাবা হবে।

প্রশ্ন ছিল, কল্পনা করে নেওয়া যাক যদি অভিনয় নিয়ে, পরিচালনা নিয়ে উত্তমকুমারের একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল সাক্ষাৎকার অথবা আলোচনা যদি থাকত তাহলে কী হত? এক মুহূর্ত সময় খরচ না করে জবাব এল, “ অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়াকে কীভাবে দেখতেন উত্তমকুমার। কারণ ওঁর অভিনয়ের পুঙ্খানাপুঙ্খ পরীক্ষা করে নিজের অভিনয়ের ধারা একটু একটু করে পাল্টেছিলেন উত্তমকুমার, নইলে ‘ছদ্মবেশী’র মাতাল আর ‘শঙ্খবেলা’র মাতাল -এর তফাৎ হয় না! তাই উত্তমকুমারের কথা শুনতে পেলে সিনেমার অভিনয়ে মূল কথাগুলো শুনতে পেতাম। একটা উদহারণ দিই - 'নায়ক'-এ যখন উত্তমকুমারকে অভিনয়ের সময় গলা তোলার নির্দেশ দিচ্ছেন সিনিয়র অভিনেতা, উত্তমের জবাব ছিল – ‘আজ্ঞে আমার কিন্তু মনে হয়, এরকম গলাই এই দৃশ্যের জন্য ঠিক।’ আর এটাই উত্তম! আসলে, উনি জানতেন ভয়েস আর্টিকুলেশন সিনেমায় যেরকম হবে, মঞ্চে তা হবে না। আর এই ব্যাপারটাই শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র বুঝতে পারেননি। তাই উত্তমকুমারের ওরকম একটা সাক্ষাৎকার থাকলে তা অভিনয় শিক্ষার শ্রেষ্ঠ মাস্টারক্লাস হতো। এবং তা আমরা করিনি। কারণ সিনেমাকে আমরা শিল্প হিসেবে ভাবিইনি, গুরুত্ব দিইনি। সেইজন্যই হয়তো উত্তমের সব ছবি সংরক্ষিত করা হয়নি। তাই চাইলেই যে উত্তমকুমারের সব ছবি দেখতে পাবেন, এমনটা নয় কিন্তু। এটা একটা অক্ষমীয় অপরাধ!
গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে যেমন একটা নির্দেশিকা লাগে, জিপিএস লাগে তেমন উত্তমকুমার ছিলেন অভিনয়ের সব থেকে বড় নির্দেশিকা। তাই উত্তমকুমারের ওরকম একটা অডিও-ভিজ্যুয়াল সাক্ষাৎকারে যদি থাকত তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেতাদের কাছে তা অভিনয় শিক্ষার রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করত।”
