চোর, মাতাল, চাকর, রিকশাচালক — পর্দায় শুধুই সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেননি অভিনেতা সুনীল মুখোপাধ্যায়। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি চলচিত্র, ধারাবাহিক এবং মঞ্চেও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। অপর্ণা সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’, গৌতম ঘোষের পরিচালনায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘তাহাদের কথা’,  ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হীরের আংটি’-র মতো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে হাজির হয়েছিলেন সুনীল। একটা সময় পর্যন্ত উৎপল দত্তের নাট্যদলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন এই অভিনেতা। এই প্রয়াত অভিনেতার জন্মমাসে তাঁকে নিয়ে নানান স্মৃতিচারণ করলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক অতনু ঘোষ। 

 

‘ময়ূরাক্ষী’, ‘রবিবার’, ‘বিনিসুতোয়’-এর মতো একাধিক জনপ্রিয় ছবির পরিচালক অতনু ঘোষ। তাঁর পরিচালিত অধিকাংশ ছবি জনতামহলের পাশাপাশি সমালোচকমহলেও বিপুল সমাদৃত। একটা সময় চুটিয়ে ধারাবাহিক ও টেলিফ্লিমও তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই সময় থেকেই তাঁর সুনীলদা র সঙ্গে পরিচয়। এদিন নিজের ফেসবুকে তাঁর সুনীলদা কে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ পোস্ট করেছেন পরিচালক।  তিনি লিখলেন, 


“কত অজস্র শিক্ষক যে ক্লাসরুমের ভেতরে, বাইরে কত জরুরি পাঠ পড়িয়ে দিয়ে গেছেন! যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমার একমাত্র লক্ষ্য পরিচালক হওয়া। একদিন এক প্রবীণ অভিনেতা বললেন, ’অভিনয় সম্পর্কে ধ্যানধারণা আছে? ওটা ছাড়া কিন্তু পরিচালনা করা যায় না!’ এর আগে এত জোর দিয়ে কাউকে বলতে শুনিনি। সবাই বলে, চলচ্চিত্রকার হওয়ার প্রাথমিক শর্ত সিনেমার ভাষা আর কারিগরি কৌশল বোঝা, শেখা।

তখনও পর্যন্ত মঞ্চ হোক বা ক্যামেরা— কোথাও অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। শুধু বুঝতাম, ক্যামেরার সামনে সহজ ও স্বাভাবিক থাকা জরুরি। ওই যাকে বলে, as if natural হওয়ার চেষ্টা। এর বেশি জ্ঞান ছিল না। সেই খামতি মেটাতে একসময় মুম্বাইয়ে রোশন তানেজার অভিনয় স্কুল অবধি পৌঁছে গিয়েছিলাম! সে অবশ্য আরেক গল্প।

মঞ্চ হোক বা সিনেমা— দু’ক্ষেত্রেই অভিনেতার চূড়ান্ত লক্ষ্য একটাই: দর্শককে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া। তবে প্রয়োগ, কৌশলে দুই মাধ্যমে বিস্তর ফারাক। তবে দুক্ষেত্রেই দক্ষ হতে দরকার দীর্ঘ সাধনা ও প্রশিক্ষণ। আর যাঁরা দুটো জগতেই সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেন, তাঁরা জানেন— কোন মাধ্যমের জন্য নিজেকে কতখানি বদলাতে হয়।

অভিনেতা সুনীল মুখোপাধ্যায়। আজকের প্রজন্ম এই নামের সঙ্গে কতটা পরিচিত জানি না। চাইলে ইউটিউবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর 'গৃহযুদ্ধ' বা রাজা মিত্রর 'যতনের জমি' দেখতে পারেন। সুনীল মুখোপাধ্যায়কে চিনতে এই দুটো কাজই যথেষ্ট। যাইহোক, থিয়েটার, সিনেমা, যাত্রা, টেলিভিশনে তখন এই তুমুল প্রতিভাধর শিল্পীর অবাধ বিচরণ। আমি সবে একটা সাপ্তাহিক টেলিভিশন সিরিজ করার সুযোগ পেয়েছি। সুনীলদার চরিত্রে দ্বৈত সত্ত্বা। ঘরে স্ত্রীর দাপটে চুপসে থাকা মানুষ, আবার মঞ্চে সেই তিনিই প্রবল প্রতাপশালী স্বামী। কাজেই সে এপিসোডে একটা নাটকের দৃশ্য থাকতে বাধ্য। শুটিং স্পট দক্ষিণ কলকাতার নিরঞ্জন সদন মঞ্চ। 

প্রথমেই ঠিক করতে হবে মঞ্চে সুনীলদার অভিনয়ের ধরন কেমন হবে। আমি কখনোই যথার্থ গুরু পেলে শেখার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। কাজেই সরাসরি সুনীলদার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম— ’আপনি বলুন, কিভাবে মঞ্চ ও ক্যামেরার অভিনয়ের তফাৎ স্পষ্ট করা যাবে।’ বললেন— ‘প্রথম ৭-৮ সারি বাদ দিয়ে দর্শক আসনের মাঝামাঝি গিয়ে বসো।’ বসে পড়লাম। প্রথমে সুনীলদা একেবারে সিনেমার ধাঁচে অভিনয় করে দেখালেন। কিন্তু দৃশ্যের আবেগ বা সত্য আমার কাছে পৌঁছল না। সেটা জানালাম। এরপর তিনি ফর্ম পাল্টালেন। নাটকের আঙ্গিকে ঢুকতেই আবেগটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। তখন বললেন— ‘এবার একেবারে শেষ রো-তে চলে যাও।’ আমি পিছনে গিয়ে বসলাম। সুনীলদার ফিজিক্যাল এক্সপ্রেশান এবার আরও কিছুটা বদলাল। দূর থেকেও চরিত্রের অনুভূতি নিখুঁতভাবে পৌঁছে গেল আমার কাছে— কোথাও কোনো ফাঁক নেই, ফাঁকি নেই!

নাটকের জন্য কোন ফর্ম বেছে নিতে হবে, আর দর্শক-অভিনেতার দূরত্ব কেন এত গুরুত্বপূর্ণ— দুটোই আমার কাছে স্বচ্ছ হয়ে উঠল। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে প্রথম সারিতে বসালেন না কেন?’ সুনীলদা মৃদু হেসে বললেন— ‘প্রথম সারি থেকে দেখলে সঠিক বিচার করতে পারতে না। সিনেমা আর নাটকের মাঝে কনফিউশনে পড়ে যেতে!’

সারা জীবনের পাঠ। যতদিন বাঁচব, মনে থাকবে। সুনীলদাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।

(ছবি: ‘গোয়েন্দা পরিবার’ সিরিজে সুনীলদার চরিত্রে দ্বৈত সত্ত্বা!)
(পোস্টের বানান অপরিবর্তিত রাখা হল) 

এই প্রসঙ্গে এরপর আজকাল ডট ইন-কে পরিচালক আরও বললেন, “সুনীলদার সঙ্গে অসংখ্য কাজ করেছি। ভীষণ প্রিয় অভিনেতা ছিলেন আমার।  অভিনেতা হিসেবে সুনীলদা কোন মাপের ছিলেন, তার সামান্য অংশ হয়তো আঁটাতে পেরেছি সমাজমাধ্যমে লেখা আমার পোস্টে। অনেকে হয়তো বলবেন শেষজীবনে অর্থকষ্টে ভুগেছিলেন সুনীলদা, সেরকম জনপ্রিয়তা পাননি। আমার কথা হল, যাঁরা জানতেন সুনীলদা কোন পর্যায়ের অভিনেতা, তাঁরা জানতেন। যাঁরা ওঁর অভিনয়গুণের ভক্ত ছিলেন, তাঁরা আজও আছেন। নইলে কী আর ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালক ওঁর অভিনয়ের গুনগ্রাহী হতেন! কোন, কোন পরিচালকের সঙ্গে উনি কাজ করেছেন দেখুন। সুতরাং, উনি ভাল কাজের সুযোগ পাননি এটা ঠিক কথা নয়।” 

 

 

শেষ জীবনে ভারী অর্থকষ্টে ভুগেছিলেন সুনীল মুখোপাধ্যায়। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই অতনু বললেন, “শক্তিশালী অভিনেতা মাত্রেই ভীষণ সফল হবেন, নামী হবেন, প্রচুর টাকা করবেন  তা কিন্তু সবসময় হয় না। সারা পৃথিবীর দিকে তাকালেই এই ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। তবে ওঁকে তো দর্শক মনে রেখেছেন। ওঁকে নিয়ে কথা হয় আজও। একজন শিল্পীর সেটাই তো প্রাপ্তি! আর একটা কথা বলি - শিল্পের মান যতই উন্নত হবে তার সমঝদারের সংখ্যা তত কমবে! এটাই তো চিরকালের নিয়ম। তাই সুনীল মুখোপাধ্যায়ের মতো ওই অত উঁচু মাপের এত অভিনেতা সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনপ্রিয় হয়ে উঠবেন এটা ভাবাটাই তো একটা হাসির খোরাক। ওঁকে নিয়ে আর একটা ঘটনা বলি, তাহলে বোঝা যাবে মানুষ হিসেবেও কত উঁচু মাপের। সেটা সম্ভবত নয়ের দশক। সুনীলদাকে নিয়ে একটা ছবির শুটিং করছিলাম। সে ছবিতে ওঁর চরিত্রটি ছিল এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীর। তো একদিনের দৃশ্য ছিল খবর এসেছে, সরকার তাঁর জন্য পেনশনের ঘোষণা করেছে, উনি সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েই রয়েছেন পেনশন পাওয়ার জন্য। তো সেই সময়ে স্পিরিট গাং ব্যবহৃত হত নকল দাড়ি ব্যবহারের জন্য...অনেক সময় তা খুলেও যেত। মানে মুশকিলের ব্যাপার ছিল বেশ। তো সুনীলদা, শত অনুরোধেও কিছুতেই ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ করলেন না, সামনে একটা লনের উপরেই চাদর পেতে রোডের মধ্যে শুয়ে পড়লেন রোদের তাপে চামড়া পোড়াবেন বলে....যাতে রোদের মধ্যে দীর্ঘ সময় না খেয়েদেয়ে লাইনে দাঁড়ানোর প পর্দায় তাঁর সেই উস্কোখুস্কো লুকটা দর্শকের চোখে আরও বাস্তবসম্মত লাগে। এরকম ছিলেন সুনীলদা!”