২০১৩ সালের ৩০শে মে। ১২ বছর আগে আজকের তারিখে বাঙালির ঘুম ভেঙেছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর খবরে। বয়স তখন মাত্র ৫০ ছুঁইছুঁই। জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালকের অকাল মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের বিনোদন জগৎ থেকে তাঁর গুণমুগ্ধ দর্শকমহল। বছরের হিসেবে এক ডজন। এত বছর পরেও তাঁর ঋতুদা র স্নেহের ডাক, তাঁর বন্ধুত্বের স্পর্শ ভোলেননি পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী।
“মানতে কষ্ট হয়, মানুষটা আর নেই। ঋতুদা যখন পরিচালক হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখছেন, ততদিনে প্রভাত রায়, স্বপন সাহা, আমি চুটিয়ে কাজ করছি। অবশ্যি মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে। ঋতুপর্ণ যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। অন্যধারার ছবির জগতে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য এক ঘরানা তৈরি করে নিলেন তিনি। দ্রুত তৈরি করে নিলেন নিজের দর্শক, যা মোটেই সহজ কাজ নয়।
অনেকে মনে করতেন বা এখনও হয়ত করেন, আমাদের এবং ঋতুদার যেহেতু ছবির ঘরানাটা আলাদা, তাই হয়ত উনি মূলধারার বাংলা ছবিকে পাত্তা দিতেন না। অত্যন্ত ভুল কথা! সব বাংলা ছবি দেখতেন ঋতুদা। খোঁজখবর রাখতেন ছোট ছোট বিষয়েও। প্রভাতদা, স্বপনবাবু, আমার ছবি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখতেন ঋতুদা। কোনওদিনও সমালোচনা করেনি বাংলা বাণিজ্যিক ছবির। বলতেন, “এত বড় বক্স অফিস সাফল্য আসছে, সেটা তো মিথ্যা নয়। দর্শক তো বোকা নয়। কেন জনপ্রিয়হচ্ছে এই ছবি, সেইটে আমি দেখতে চাই। কারণটা বুঝতে চাই।' আমার ছবি দেখে আলোচনায় বসতেন আমার সঙ্গে। কোথায় ঠিক, কোথায় ভুল-খুঁত এসব নিয়ে আলোচনা করতেন, পরমার্শ দিতেন। একটা ঘটনা বলি, তখন শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ রমরমিয়ে চলছে। প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণা এবং আমি গড়িয়ার মহুয়া প্রেক্ষাগৃহে হল ভিজিট এ গিয়েছি। সেখান থেকে বেরোনোর সময় দেখি দলবল নিয়ে পরের শো দেখতে ঢুকছে ঋতুপর্ণ ঘোষ! ভাবতে পারেন! আমাকে তো ঋতুদা বলত, তোদের মতো তোরা ভাল কাজ করছিস। এটাই ইম্পর্ট্যান্ট। '
আরও একটা ব্যাপার বলি, এটা হয়ত অনেকে জানেন না। আমার পরিচালিত ছবি রণক্ষেত্রে দু'টো গান লিখে দিয়েছিল ঋতুদা! প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে। প্রসেনজিৎ-শতাব্দী সে ছবির নায়ক-নায়িকা ছিলেন। সংগীত পরিচালক হিসেবে দেবজ্যোতি মিশ্রের ওটাই প্রথম ছবি। যাই হোক, যেটা বলছিলাম... একজন মূলধারার বাণিজ্যিক পরিচালকের ছবির গান লিখে দিচ্ছেন অন্যধারার ছবি ঘরানার একজন এত বিখ্যাত পরিচালক। বর্তমান সময়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালে এ ঘটনা কল্প-কথা মনে হবে। আসলে, তখন ইন্ডাস্ট্রি একটা পরিবার ছিল। সবাই আড্ডা মারত, পরস্পরের পাশে থাকত, হইহই একটা ব্যাপার ছিল।
আর একটা কথা বলি, বর্তমানে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির বহু শিল্পী, টেকনিশিয়ানরা হয়ত ঋতুপর্ণ ঘোষের নাম শুনলে হয়ত চিনতে পারবে না, তবে তাতে কিছু যায় আসে না!”
