বেঁচে থাকলে এদিন তাঁর বয়স হত ১০২। তিনি, পরিচালক মৃণাল সেন। মৃণাল সেনের হাত ধরেই এক সময় বাংলা ছবিতে পা রেখেছিলেন রঞ্জিত মল্লিক। ১৪ মে প্রয়াত পরিচালকের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সঙ্গে নিজের সফরকে ফিরে দেখলেন রঞ্জিত। স্মৃতির দীঘিতে ছোট ছোট ডুব দিয়ে তুলে আনলেন মনের সিন্দুক থেকে তুলে আনলেন অমূল্য সব মণিমুক্তা। শুনলেন রাহুল মজুমদার।
“মৃণাল সেনকে কোনওদিন মৃণালদা ডাকিনি। বরাবর ডেকে এসেছি মৃণালবাবু। আর উনি আমাকে ডাকতেন শ্রীমান বলে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাইই ডেকে গিয়েছেন। কোনওদিন রঞ্জিত বলে ডাকেননি, নেভার! একথা বহুবার বলেছি, আজও বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই আমার অভিনয়ের, ক্যামেরা মুখোমুখি হওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছি মৃণালবাবুর থেকে। আমি অভিনয়ের তেমন কিছু একটা জানতাম না। প্রযুক্তির কলাকৌশল ব্যাপারটা তো ছেড়েই দিন। আমাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছিলেন মৃণালবাবু। সেটা ১৯৭০ সাল। শুনলাম, মৃণালবাবু কলকাতার নতুন প্রজন্মের সমস্যা নিয়ে ছবি তৈরি করবেন। সত্যজিৎ রায়-ও করছেন ওই একই বিষয়ে। নাম, প্রতিদ্বন্দ্বী। যাই হোক, ওই ছবির সূত্রে মৃণালবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমার এক কাকার সঙ্গে আলাপ ছিল মৃণাল সেনের। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, যদি আমার সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দেন। দিয়েছিল। আমি কিন্তু ভাই আর কোনওদিন কারও সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার কথা বলিনি। আর একটা কথা, আমি কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতেও গিয়েছিলাম প্রতিদ্বন্দ্বী তে অভিনয়ের জন্য। সত্যজিৎ রায় আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, তাঁর কাস্টিং হয়ে গিয়েছে। যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে আমাকে ডেকে পাঠাবেন। ব্যস, এটুকুই।
যাই হোক, মৃণাল সেনের প্রসঙ্গে ফিরি। মৃণালবাবুকে জানালাম যে উনি যে বিষয়ে ছবি করতে চলেছেন সেটা কিন্তু আমার জানা। কারণ চারপাশে আমার বন্ধুদের কাছেও আমি একই সমস্যা শুনেছি— বেকারত্ব বাড়ছে। উনি শুনে খানিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর স্ক্রিন টেস্টের জন্য একটা ডেট দিলেন। জায়গা, ঢাকুরিয়া লেকের ধরে। গেলাম, আমাকে নিজের মতো করে কথা বলতে বললে, যদিও অল্প সংলাপ ধরিয়ে দিয়েছিলেন।...আর কিচ্ছু নয়। আমিও বললাম। ওঁর সঙ্গে সেদিন কে কে মহাজন ছিলেন। ওঁর ক্যামেরাম্যান। এরপর খবর এল, উৎরে গিয়েছি। ইন্টারভিউ ছবিতে আমি অভিনয় করছি!
মৃণাল সেনের ছবিতে কাজ করা মানে একটা চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। কখনও কোনও দৃশ্যের সংলাপ থাকত, কখনও থাকতই না। নিজেকে বলতে হত, তৈরি করতে হত তৎক্ষণাৎ অবশ্যই ওঁর নির্দেশে এবং ওঁর তদারকিতে। একটা মজার ঘটনা বলি, ইন্টারভিউ ছবিতে একটি দৃশ্য আছে যে এক পকেটমারকে ধরে আমি থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনের শুটিংয়ে গিয়ে ওঁর সহকারীদের বললাম, ভাই কী কী সংলাপ আছে? উনি বললেন, সংলাপ তো কিছু নেই। আমি তো অবাক। ভাবলাম উনি মজা করছেন। বার বার বললাম যে আমি নতুন, অতটা এক্সপার্ট নই। মৃণালবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘‘ধুর, পুলিশ যা প্রশ্ন করবে, তার উত্তর দিয়ে দেবে।’’ পরে শুধু বললেন, ‘‘মাথায় রাখবে তোমায় তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। কারণ বিকাল ৩টে নাগাদ তোমার একটা ইন্টারভিউ আছে। আর পুলিশ অফিসারের অভিনেতাকে বলে দিলেন যে, এমন অভিনয় করতে যেন উনি আমাকে একটু দেরি করিয়ে দিতে চাইছেন। বিশ্বাস করুন, এইভাবে সিনটা শুটও হয়ে গেল। আমি তখনও হাঁ। জীবনে আর এ অভিজ্ঞতা হয়নি।”
“অসম্ভব উইটি ছিলেন মৃণালবাবু। কী রসবোধ। সব কথা এখানে বলা যাবে না। বুঝতেই পারছেন... ওঁর মতো ওরকম গাম্ভীর্য ব্যক্তিত্বের বিরাট মাপের মানুষ যে ওরকম মজার মজার কথা বলতে পারেন তা না শুনলে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মানিকদা মানে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় যখন শাখাপ্রশাখা ছবিতে অভিনয়ের ডাক পেলাম, খুশি হয়েছিলেন মৃণালবাবু। বলেছিলেন, ‘খুব খুশি হয়েছি। মন দিয়ে কাজ করবে শ্রীমান।’ তারপর ছবি দেখে আমাকে নিজে ফোন করে জানিয়েছিলেন আমার অভিনয় ওঁর মনে ধরেছে – “বুঝেছ শ্রীমান, ‘শাখাপ্রশাখা’ দেখলাম। ছবি নিয়ে নানান আলোচনা হতে পারে কিন্তু তোমার পারফরম্যান্স দারুণ লেগেছে। খুব ভাল কাজ করেছ।’ এগুলো কী জীবনের কম বড় পুরস্কার বলুন? এই ছিলেন আমার মৃণালবাবু...”
“ও হ্যাঁ, আর একটা কথা ভাই। ‘ইন্টারভিউ’-এর জন্য আমার কেরিয়ারে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাই। চেক প্রজাতন্ত্রের কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাই। দিনটা ছিল ২ অগস্ট। তার পর থেকে শুরু হল এক অন্য সফর। প্রতি বছর ওই দিনে মিষ্টি নিয়ে আমি সকাল সকাল মৃণালবাবুর সঙ্গে দেখা করতে ওঁর বাড়িতে যেতাম। একটানা ৪০ বছরেরও বেশি গিয়েছি। মনে হত, ওইদিন আমার নবজন্মের দিন। আজ মৃণালবাবুর জন্মদিন। এই দিনটায় ওঁর কথা খুব মনে পড়ে। এখনও মিস করি। সত্যিই মিস করি মৃণালবাবুকে।”
