হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল তাঁর মেধা, সংবেদনশীল মন আর গভীর মানবিকতা। ‘ম্যায় হুঁ না’, ‘কল হো না হো’, ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, ‘জানে ভি দো ইয়ারো’-এর মতো একের পর এক দর্শকপ্রিয় ছবিতে তিনি হাসিয়েছেন, মুগ্ধ করেছেন। টেলিভিশনে ‘ইয়ে যা হ্যায় জিন্দেগি’ আর ‘সারাভাই ভার্সেস সারাভাই’ তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল ঘরে ঘরে। সেই অভিনেতা সতীশ শাহ আর নেই। ৭৪ বছর বয়সে কিডনি বিকল হয়ে গত শনিবার প্রয়াত হয়েছেন দর্শকপ্রিয় এই বর্ষীয়ান অভিনেতা।
সতীশ শাহ-এর সঙ্গে এক সময় কাজ করেছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক অতনু ঘোষ। ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘রবিবার’, ‘বিনিসুতোয়’-এর মতো একাধিক জনপ্রিয় ছবির পরিচালক তিনি। তাঁর পরিচালিত অধিকাংশ ছবি জনতামহলের পাশাপাশি সমালোচকমহলেও বিপুল সমাদৃত। সমাজমাধ্যমে প্রয়াত অভিনেতাকে শ্রর্দ্ধার্ঘ্য জানানোর পাশাপাশি আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে এই জনপ্রিয় বাঙালি পরিচালক আলোচনা করলেন সতীশ শাহের অভিনয়ের নানান দিক, স্মৃতিচারণ করলেন টুকরো টাকরা ব্যক্তিগত মুহূর্তের কথা।
আরও পড়ুন: ‘নিজের চেহারাটাই ছিল আমার সবথেকে বড় শত্রু!’ কেন বারবার এ কথা বলতেন সতীশ শাহ?
প্রয়াত বলি-অভিনেতাকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে পরিচালক অতনু ঘোষ লিখেছেন, “তাঁর নাম এলেই মন এক ধাক্কায় ফিরে যায় দুরদর্শনের সেই সোনালি দিনে। ১৯৮৪ সালের ‘ইয়ে যা হ্যায় জিন্দেগি’–র সময়ে। উষ্ণতা, দুষ্টুমি আর নিখাদ মানবিকতার মিশেলে গড়ে উঠেছিল সেই ধারাবাহিক; একেবারে মধ্যবিত্ত জীবনের নিঃশব্দ অথচ মিষ্টি প্রতিচ্ছবি। হাসিতে ছিল হালকা খোঁচা, কিন্তু কখনও বিদ্রুপ নয়। আবেগে ছিল কোমলতা, কিন্তু একফোঁটাও বাড়াবাড়ি নয়। কুন্দন শাহ-দের মতো মেধাবী স্রষ্টাদের কল্যাণে প্রতিটি পর্বই হয়ে উঠেছিল এক ছোট্ট গল্প-যেখানে জীবনের টুকরো টুকরো ঘষাঘষিতেই জন্ম নিত অনাবিল হাসি।
আর সেই জগৎটাই সতীশ শাহ বানিয়েছিলেন নিজের খেলাঘর। তাঁর অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, উদ্ভাবনী আর এক কথায় অনন্য। কোথাও পড়েছিলাম, তিনি এই ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন পঞ্চাশটিরও বেশি চরিত্রে! প্রতিটি চরিত্র আলাদা কণ্ঠ, ভঙ্গি, উচ্চারণ আর তাল নিয়ে গড়া। কখনও বোঝাই যেত না, পরের পর্বে কোন অবতারে হাজির হবেন তিনি। আর সেই অনিশ্চয়তাই ছিল দর্শকের আনন্দের উৎস। তবে সতীশ শাহের প্রকৃত জাদু শুধু বহুমুখী প্রতিভায় নয়, ছিল তাঁর অনাড়ম্বর সৌন্দর্যে। তিনি হাস্যরসেও এনে দিয়েছিলেন রুচি, বোকামিতায় উষ্ণতা, আর নিখাঁদ স্ল্যাপস্টিকেও সরল সত্যর ছোঁয়া।
পরবর্তীকালে আমরা তাঁকে আবারও নতুন করে ভালবেসেছি ‘জানে ভি দো ইয়ারো’, ‘সারাভাই ভার্সেস সারাভাই’ কিংবা আরও বহু কাজের মাধ্যমে। কিন্তু ‘ইয়ে যা হ্যায় জিন্দেগি’–র জায়গাটা অন্যরকম। কারণ, তখনকার দিনে টেলিভিশনের তারকারা তারকা ছিলেন না, ছিলেন আমাদের বাড়িরই মানুষ। প্রতি সপ্তাহে যেন অতিথি হয়ে আসতেন, হাসিয়ে যেতেন, জীবনের হালকা ক্লান্তি মুছে দিতেন, আর অজান্তেই আমাদের দিনগুলো করে তুলতেন একটু বেশি সুন্দর।”
এই প্রসঙ্গেই আজকাল ডট ইন-কে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্র পরিচালক বললেন, “এফটিআইআই থেকে পাশ করে বলিপাড়ায় পা রেখেছিলেন সতীশ শাহ-দের প্রজন্মের এক ঝাঁক অভিনেতারা। সতীশ তো ছিলেনই, এই তালিকায় আরও ছিলেন বিবেক বাসওয়ানি, রবি বাসওয়ানি, টিকু তিলসানিয়া। অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন তনাজ করিম, সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়। সুস্মিতা-মানে যিনি পঙ্কজ কাপুরের সঙ্গে ‘করমচাঁদ’-এ চুটিয়ে অভিনয় করেছিলেন। এই যে ‘গ্রূপ অফ অ্যাক্টরসরা’ এসেছিলেন, তাঁদের যে রসবোধটা ছিল তা এককথায় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। খুব সহজে জীবন থেকে বেরিয়ে আসত। ওঁরা কিন্তু ছোটপর্দার তারকা ছিলেন। সতীশ শাহ তো বটেই, বাকিরাও এতটা জনপ্রিয় হয়েছিলেন কারণ আমাদের মনে হত, প্রতি সপ্তাহেই ওঁরা আমাদের বাড়িতে আসে, আমাদের সঙ্গে হাসে, হাসায় এবং চলে যায়।”
“সেই সময়ের পরিচালকদের কথাটাও একটু বলা উচিত। কুন্দন শাহ, সৈয়দ মির্জা, লেখ ট্যান্ডনরা ছিলেন ভারতীয় টেলিভিশনের একেবারে শুরুর সময়ের পরিচালক। এঁদের প্রতিভা ছিল ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে এঁদের লেখা। জীবনের ভিতর থেকে যেভাবে হাসি-মজা বের করে আনতেন তা অনবদ্য। শরদ যোশীর ‘ইয়ে যো হ্যায় জিন্দেগি’ ধারাবাহিক তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আর তা দুরন্তভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন সতীশ! নইলে এই ধারাবাহিকে কি আর পঞ্চাশটিরও বেশি চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন তিনি? এবার ভাবুন, একজন অভিনেতা, একজন পরিচালক আর একজন লেখকের কতটা ক্ষমতা থাকলে, তাঁরা তিনজন মিলে ওইরকম ভাবে একটা কমেডিকে বেশি নাটকীয় না করে, ভাঁড়ামির পর্যায়ে না নিয়ে গিয়ে, অত সহজভাবে পেশ করতে পেরেছিলেন। আর এগুলোই কিন্তু সেই সময়ে ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করে দিয়েছিল, 'জানে ভি দো ইয়াঁরো'র মতো কমেডি ক্লাসিক ছবি তৈরির। এই ফাঁকে নাম করব অভিনেতা টম অল্টারের-ও। ‘জবান সামহালকে’ তে কী অভিনয়টাই না করেছিলেন! সেই সময়টা ছিল ‘গোল্ডেন পিরিয়ড অফ টেলিভিশন’। সতীশ শাহ-র মতো এরকম একজনের মতো তাই চলে যাওয়াটা তাই খুব দুঃখজনক।”
“পরবর্তী সময় আমি এঁদের অনেকেই কাছ থেকে দেখেছি। তখন আমি বোম্বেতে সম্পাদনার কাজ করি। ওঁদের সঙ্গে আলাপ-আড্ডা হত। সম্পাদনা করতে করতে ছোটখাটো ডাবিংয়ের কাজও ওই এডিটিং রুমে মাইক বাড়িয়ে-টসিয়ে আমরা সম্পাদক-রাই করে দিতাম। যদিও সিঙ্ক সাউন্ডেই সব শুট হত, তারপরেও যেটুকু ডাবিংয়ের প্রয়োজন হত আমরা সম্পাদকরা করে দিতাম। যাই হোক, সেই সময়ে সতীশ শাহ-র সঙ্গে আলাপ। তুখোড় আড্ডাবাজ, দুরন্ত রসবোধ যুক্ত একজন মানুষ ছিলেন। আর ভীষণ সহজ! মনে আছে, একবার ডাবিংয়ের কথা বলেছি অল্প একটু অংশের জন্য। শোনামাত্রই তড়িঘড়ি কাতর স্বরে আমাকে মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘করব, করব। আমিই ডাবিংটা করব। তবে আমার নাটক আছে আজ। সেটা শেষ করেই স্টুডিওতে এসব। একটুখানি রাত হবে, অপেক্ষা করো। তুমি কিন্তু অন্য কাউকে দিয়ে আবার করিয়ে দিও না। কেমন?’ খুব ভাল মানুষ ছিলেন। আসলে, ওই প্রজন্মের অভিনেতাদের রসবোধটা তুমুল ছিল। প্রখর জীবনবোধ ছিল। জীবনের মধ্যে কোন জায়গার অসঙ্গতি থেকে হাসিটা বেরিয়ে আসে, সেটা ওঁরা বুঝতেন। তাই অভিনয়ের মাত্রা রাখাটা খুব ভালভাবে বুঝতেন। কমেডি অভিনয়ে কী করলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, স্পষ্ট ধারণা ছিল সেই বিষয়ে সতীশ শাহের। সতীশ শাহ একজন দুরন্ত অভিনেতাও ছিলেন, শুধু কমেডিতেই কিন্তু ওঁর অভিনয়ের সীমাবদ্ধতা ছিল না। আর এ কথাটা সেই সময়ের টলিপাড়ার কৌতুকাভিনেতাদের ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে লাগসই!”
“আর একটা কথা, বর্তমানে টেলিভিশনের স্পেসটা অনেককটে বদলে গিয়েছে। তাই হয়তো সেই প্রজন্মের ওরকম বাঘা বাঘা অভিননেতাদের অনেকেই আজ একটু একটু করে হারিয়ে গিয়েছেন। তবু এর মধ্যেই মাথা উঁচু করে 'সারাভাই' কিন্তু ছিল। আর তাতে কতটা কৃতিত্ব সতীশ শাহের, তা তো সহজেই অনুমেয়।”
