সোমবার বর্ষীয়ান পরিচালক সন্দীপ রায়ের জন্মদিন। এদিন ৭২ ছুঁয়ে ফেললেন সত্যজিৎ-পুত্র। অস্কারজয়ী, কিংবদন্তি পরিচালকের পুত্র হওয়ার অপরিসীম চাপ সামলেও ছবি পরিচালনা থেকে সুর তৈরিতে নিজের স্বকীয়তা বহাল তবিয়তে বজায় রেখেছেন সন্দীপ রায়। পাশাপাশি পুরোদমে চলেছে নানান ধরনের লেখালেখির কাজ এবং সময়-সুযোগে আঁকাআঁকিও। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন আরেক জনপ্রিয় পরিচালক অনীক দত্ত। জন্মদিনে তাঁর বাবুদা কে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি অতীত হাতড়ে তুলে আনলেন নানান রঙের সুখজাগানিয়া স্মৃতি। আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে অনীক দত্তের এই একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সাক্ষী থাকলেন রাহুল মজুমদার। 

 

 

 

“বাবুদা, আর আমি একই স্কুলের ছাত্র। পাঠভবনের একেবারে প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন উনি, সঙ্গে মৃণাল সেনের ছেলে, কিশোরকুমারের ছেলে। ওঁদের থেকে আমি অনেকটাই ছোট। তবে স্কুলের ছাত্র থাকাকালীনই বাবুদার সঙ্গে আমার আলাপ, তবে মুখোমুখি নয়। সন্দেশে ছোট ছোট কার্টুনের স্ট্রিপ আঁকতেন উনি, আমরা তখন সন্দেশ গোগ্রাসে গিলতাম। সেই বাবুদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার, ওই দু’মলাটের মধ্যে। এরপর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে জোট বেঁধে আমাদের পাঠ ভবনের মাস্টারমশাই পার্থ বসু সহ-সম্পাদনা করেছিলেন সুকুমার-সত্যজিৎ সমগ্র। তো স্বভাবতই রায় বাড়িতে ওঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তখন সন্দীপ রায়ের জন্য সত্যজিৎ রায় বিদেশ থেকে টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স-এর বিশ্ববিখ্যাত সব কমিকস নিয়ে আসতেন।

 

 

পার্থবাবু সেসব কমিকস আমাদের জন্য চেয়ে নিয়ে আসতেন। আমাদের পড়ার জন্য। সাবধানে সেসব কমিকস উল্টেপাল্টে দেখার নির্দেশ পেতাম, কারণ জানতাম সেগুলো আদতে কার...তো একদিক থেকে দেখতে গেলে, বাবুদের জন্যেই আমার প্রথম টিনটিন-অ্যাস্টেরিক্স-এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।” স্মিত হেসে বলে উঠলেন ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’ ছবির পরিচালক। 

 

 

 

খানিক থেমে  তিনি আরও বললেন, “বাবুদার সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি আলাপ 'ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবি তৈরির সময়। আমার ছবি দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেই থেমে থাকেননি তিনি, সেই সময়ে নিজের একাধিক সাক্ষাৎকারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমার সেই ছবির প্রচারও করেছিলেন। আমি তখনই জানতে পারি, আমার করা বিজ্ঞাপনের নানান কাজের খোঁজ উনি রেখেছেন। খুবই আপ্লুত হয়েছিলাম। আমি তো বলব, বাবুদার শিল্পী সত্তার যতই প্রশংসা করা হোক, মানুষ হিসেবেও তিনি অতুলনীয়। ওঁকে যত দেখি, অবাক হই। অদ্ভুত মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। রায়-বাড়ির ভদ্রতা তো প্রায় প্রবাদের আকার নিয়েছে...ওঁর মতো আদ্যপান্ত ভদ্রমানুষ আজকের দিনে বিরল। আর যদি ব্যস্ত না থাকেন, ওঁর মতো জমাটি আড্ডা খুব কম মানুষকেই মারতে দেখেছি। এখানে একটা কথা অবশ্যই বলা উচিত, যেটা শুনলে বুঝবেন পরোপকারী হিসেবে ওঁর ব্যক্তিত্বের দিকটি। ‘অপরাজিত’ ছবির ভাবনা যখন ওঁকে বলি, খুশি হয়েছিলেন। লিখিত অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি নানান সাজেশন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি যেন মূল চরিত্রের নামগুলো সামান্য বদলে ফেলি। কারণ সত্যজিৎ রায়ের আশেপাশে তো আরও বড় বড় সব নাম ছিল আমার ছবিতে, এবার ধরুন যদি তাঁদের আত্মীয়-পরিজন যদি হঠাৎ দাবি তোলেন যে, ছবিতে যা দেখানো হয়েছে এরকম কোনও বক্তব্য রাখেননি, তখন? যদিও সেই সম্ভাবনা একেবারেই প্রায় ছিল না, কারণ প্রচুর রিসার্চ করে ছবিটা তৈরি করেছিলাম। তবু, বাবুদার এই টিপস আমার  কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, তাই ব্যবহার করেছিলাম। ‘অপরাজিত’-তে প্রতিটি প্রধান চরিত্রের নাম একটু এদিক-ওদিকে করে দিয়েছিলাম। 

 


দেখুন, পরিচালক হিসেবে ওঁর প্রথম ছবি ‘ফটিকচাঁদ’-এই নিজের স্বকীয়তার ছাপ রেখেছিলেন তিনি। এত বছর ধরে ছবি তৈরি করে আসছেন, জনপ্রিয়তা না থাকলে এটা কোনওভাবেই সম্ভব হত না। সত্যজিতের লেখা গল্প-উপন্যাস ছাড়াও নিজের লেখা গল্প নিয়েও একাধিক ছবি তৈরি করেছেন বাবুদা যা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এছাড়া তো বলতেই হয়, ফেলুদা ছবির কথা। বড়পর্দায় ফেলুদা দেখার আজও যে আগ্রহ, তা তো বাবুদার কারণেই। এছাড়াও সত্যজিৎ, শরদিন্দু নানান জনপ্রিয় লেখকের ছোটগল্প জুড়ে জুড়ে যেসব ছবি উনি তৈরি করেছেন, সেটাও কিন্তু কম ইন্টারেস্টিং নয়।  এখানে একটা কথা না বললেই নয়, ‘প্রফেসর শঙ্কু’র গল্প নিয়ে ছবি তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ, সেটাও কিন্তু বাবুদা দারুণভাবে করে দেখিয়েছেন।” 

 

“জন্মদিনে বাবুদাকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। আমি একটু পরেই ফোন করব ওঁকে। উনি সুস্থ থাকুন, ভাল ভাল সব ছবি তৈরি করুন। আর হ্যাঁ, এই পুজোয় আমার ছবিটা দেখে নেবেন সময় করে।” কথা শেষে হাসতে হাসতে নিজের অননুকরণীয় ছন্দে বলে উঠলেন অনীক দত্ত।