আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতে সোনার ঋণ আর শুধু বিপদের দিনে শেষ অবলম্বন নয়, বরং মূলধারার একটি জনপ্রিয় ঋণপণ্য হয়ে উঠেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট নাগাদ দেশে সোনাভিত্তিক ঋণের মোট বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২.৯৪ লক্ষ কোটি টাকা। এক বছর আগের জুলাই ২০২৪-এ এই অঙ্ক ছিল মাত্র ১.৩২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১২২%।


শুধু তাই নয়, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষেই সোনার ঋণ বেড়েছে ১০৩%, যা এক বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর যেখানে এই খাতে ঋণ ছিল প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা, সেখানে চলতি অর্থবছরে তা ছুঁয়েছে ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যক্তিগত ঋণ মাত্র ৮% এবং ক্রেডিট কার্ড ঋণ ৬% হারে বেড়েছে। ফলে স্পষ্ট, সোনার ঋণের চাহিদা অন্য সব ভোক্তা ঋণকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।


এই প্রবণতার অন্যতম চালিকা শক্তি হল সোনার দামে বিরাট লাফ। ২০২৫ সালে সোনার দাম বেড়েছে ৪৪.১%। ২০২৪ সালের শেষে যেখানে ১০ গ্রাম সোনার দাম ছিল ৭৮,৯৫০ টাকা, সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ তা ছুঁয়েছে ১,১৩,৮০০ টাকা। ফলে ঋণগ্রহীতারা তুলনামূলকভাবে কম সোনা বন্ধক রেখেও বড় অঙ্কের ঋণ পাচ্ছেন। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন: রাহুল গান্ধীর ‘ভোট চুরি’ অভিযোগে নতুন মোড়, নাম করেই নির্বাচন কমিশনকে নিশানা


রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একাধিক সিদ্ধান্তও সোনার ঋণের প্রসারে ভূমিকা রেখেছে। কৃষিঋণকে সোনার ঋণ হিসেবে পুনঃশ্রেণিবিন্যাস, এনবিএফসি–র ঋণদানের ওপর কড়াকড়ি এবং নতুন ধাপভিত্তিক লোন-টু-ভ্যালু নির্দেশিকা ঋণগ্রহীতাদের জন্য প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করেছে। এর ফলে ঋণপণ্যটি আরও বেশি মানুষের নাগালে এসেছে এবং সুরক্ষাও বেড়েছে।


সোনার ঋণের বিশেষ সুবিধা হল দ্রুততা ও নমনীয়তা। ন্যূনতম নথিপত্র লাগে, অনুমোদন হয় মুহূর্তের মধ্যে। এমনকি যাদের ক্রেডিট হিস্ট্রি দুর্বল বা ব্যাঙ্কিং অভিজ্ঞতা সীমিত, তারাও সহজে ঋণ পাচ্ছেন। অন্যদিকে, সুদের হার গড়ে ৮–১২%, যা ব্যক্তিগত ঋণ বা ক্রেডিট কার্ড ঋণের তুলনায় কম।
ডিজিটাল প্রযুক্তি এই বাজারকে আরও প্রসারিত করেছে। অনেক ব্যাঙ্ক ও ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম এখন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সম্পূর্ণ কাগজবিহীন আবেদন, এআই-ভিত্তিক মূল্যায়ন এবং তাত্ক্ষণিক অনুমোদন দিচ্ছে। এতে শহুরে তরুণদের পাশাপাশি গ্রামীণ গ্রাহকও সমানভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
আগে সোনার ঋণ মূলত জরুরি নগদ প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো। এখন তার ব্যবহার বহুমুখী। বিয়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খরচ, ছোট ব্যবসা, মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজের কার্যকরী মূলধন—সব ক্ষেত্রেই সোনার ঋণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চাহিদা শুধু শহরে নয়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা সহ গ্রামীণ ও আধা-শহুরে অঞ্চল জুড়ে সমানভাবে বিস্তার লাভ করেছে।


এক সময় ‘শেষ ভরসা’ মনে হলেও এখন সোনার ঋণ সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে মূলধারার পণ্য হয়ে উঠছে। নীতিগতভাবে যেখানে অনিরাপদ ঋণের ওপর (ব্যক্তিগত ঋণ, ক্রেডিট কার্ড) ঝুঁকি-ওজন ও সুদ বাড়ছে, সেখানে জামানতভিত্তিক ঋণের দিকেই ঝুঁকছেন ঋণগ্রহীতা।


বিশ্লেষকদের মতে, সোনার ঋণের উত্থান ভারতের বৃহত্তর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করছে। আয় অনিশ্চয়তা, ব্যয়ের চাপ এবং সুরক্ষিত অথচ নমনীয় ঋণের চাহিদা মিলে সোনার ঋণকে করেছে “লাইফলাইন”। উচ্চ সোনার দাম, অনুকূল নিয়ন্ত্রক পরিবেশ, ডিজিটাল অ্যাক্সেস এবং গ্রাহক মনোভাবের পরিবর্তন মিলে ২০২৫ সালে সোনার ঋণকে ভারতের খুচরা ঋণ বাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।