আজকাল ওয়েবডেস্ক: ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য যে শব্দকে বিপ্লবীরা 'রণধ্বনি' হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন তা হল 'বন্দে মাতরম'। এর অর্থ 'মা তোমাকে বন্দনা করি'।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা 'বন্দে মাতরম' প্রথমে গান হিসেবে লেখা হলেও ১৮৮২ সালে তা 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত হয়।বঙ্কিমচন্দ্রের রচিত এই গান বহু যুগ ধরে অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীকে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করেছে।
শুক্রবার থেকে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় গান 'বন্দে মাতরম'-এর সার্ধশতবর্ষ। শুক্রবার এই গানের দেড়শ বছর পূর্তিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ঘোষণা করা হয়েছে, এই গানের সার্ধশতবর্ষ স্মরণ করে সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। তবে এই সবকিছুর মধ্যেও এই বিশেষ গানের সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত লালগোলা অন্ধকারেই রয়ে গিয়েছে।
বন্দে মাতরম গানটি সঠিক কত তারিখে কোথায় লেখা হয়েছিল এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও মুর্শিদাবাদে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত থাকার সময় বঙ্কিমচন্দ্র লালগোলা রাজবাড়ির পটভূমিকায় এই গান রাজার অতিথি নিবাসে বসে লিখেছিলেন বলেই বেশিরভাগ লোক মনে করেন।

ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে জানা যায়, ১৮৭৩ সালে বহরমপুর শহরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র কর্মরত থাকার সময় একদিন পালকি করে বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
তখন এক ব্রিটিশ কর্নেল সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিলেন। ওই মাঠ দিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে কর্নেল এবং তাঁর বন্ধুদের বিবাদ হওয়ায় বঙ্কিমচন্দ্রকে সেই সময় ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
এরপর ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসেই ওই কর্নেলের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন বঙ্কিমচন্দ্র। ১৮৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি কোর্টের রায়ে বঙ্কিমচন্দ্রের জয় হয় এবং ওই কর্নেলকে প্রকাশ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল।
'বন্দে মাতরম ও আনন্দমঠের উৎসভূমি লালগোলা' গ্রন্থের লেখক সুমন কুমার মিত্র বলেন, 'বঙ্কিমচন্দ্রের হয়ে ওই মামলায় প্রধান সাক্ষী হয়েছিলেন লালগোলার মহারাজ রাও যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়। মামলার রায় বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে যাওয়ার পর ব্রিটিশদের কাছে তাঁর জীবন সংশয় হতে পারে এই আশঙ্কা করে মহারাজা বঙ্কিমচন্দ্রকে লালগোলার রাজবাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান।'
তিনি বলেন, 'এই ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই ম্যালেরিয়ার কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিল। তাই তিনি সরকারের কাছে ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু সেই আবেদন মঞ্জুর না হওয়া সত্ত্বেও লালগোলার মহারাজার আমন্ত্রণের সাড়া দিয়ে জানুয়ারি মাসেই লালগোলায় চলে আসেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই লালগোলা রাজবাড়ি এবং কলকলি নদীর প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত বন্দে মাতরাম গানের 'বন্দে মাতরম্ সুজলাং সুফলাং' থেকে 'রিপুদলবারিণীং মাতরম্' অংশটি লিখেছিলেন।'
বঙ্কিমচন্দ্র কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে লালগোলার মাটিতে এই গান লিখেছিলেন তা বোঝাতে গিয়ে সুমন বলেন, '১৮৭৪ সালে জানুয়ারি মাসের শেষ দিন এবং ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন মাঘী পূর্ণিমা ছিল। লালগোলার মহারাজদের মূল নিবাস উত্তর প্রদেশে হওয়ায় তাঁদের পরিবারে বড় করে এই দিনটি পালন করা হত। সেই সময় উত্তরপ্রদেশ এবং অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর সন্ন্যাসী রাজ পরিবারের আমন্ত্রণে লালগোলায় আসতেন। লালগোলায় এসে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের মাঝে বঙ্কিমচন্দ্র দেখতে পেয়েছিলেন রাজ পরিবারের জগদ্ধাত্রী ঠাকুর, মন্দিরে শৃঙ্খলিত কালী মায়ের মূর্তি এবং রাজগুরু পরিবারের দুর্গা মূর্তি। লালগোলা রাজ পরিবারে মায়ের তিন ধরনের যে মূর্তি তিনি দেখেছিলেন তাঁর সেই বর্ণনা আমরা 'আনন্দমঠ'-এ দেখতে পাই। সেখানে তিনি মুক্ত জগদ্ধাত্রী ঠাকুরকে 'ভারত মা' হিসেবে দেখে লিখেছিলেন 'মা যা ছিলেন', শৃঙ্খলিত কালীমূর্তিকে পরাধীন ভারতের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছিলেন 'মা যা হয়েছেন' এবং রাজগুরু পরিবারের দুর্গা মূর্তির সঙ্গে তিনি স্বাধীন ভারতের তুলনা করে লিখেছিলেন 'মা যা হইবেন'। এই ধরনের মন্দির ভারতবর্ষের আর কোথাও নেই যা দেখে বঙ্কিমচন্দ্র এই গান অন্য কোথাও লিখে থাকতে পারেন।'
বিখ্যাত এই গানের বিভিন্ন কথা উদ্ধৃত করে সুমনবাবু বলেন, 'এই গানের একটি লাইনে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন 'সপ্ত কোটি কণ্ঠ কলকল নিনাদ করালে'। ১৮৭১ সালের প্রথম জনগণের 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রভিন্স'- এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬ কোটি ৯৫ লক্ষ। যা ১৮৭৪ সালে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সাত কোটিতে। এই ঘটনা ইঙ্গিত করে ১৮৭৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র লালগোলায় থাকাকালীন এই গান লিখেছিলেন। ১৮৭৪ সালের অক্টোবর মাসে 'কমলাকান্তের দপ্তর'-এ 'আমার দুর্গোৎসব প্রবন্ধে' এক জায়গায় তিনি লিখছেন, 'মা তোমার ছয় কোটি সন্তান'। কারণ ১৮৭৪ সালের ৮ এপ্রিল 'প্রথম বঙ্গভঙ্গ' হয়। সেই সরকারি নির্দেশে কাছার, গোয়ালপাড়া এবং সিলেট এই তিন প্রদেশ ভাগ হয়ে অসমের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বাংলা থেকে প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যা বাদ হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে দু'টি পৃথক লেখায় দু'টি পৃথক জনসংখ্যার উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই স্পষ্টই করে দিয়েছেন এই গান তিনি লালগোলাতেই লিখেছিলেন।'
বহু ঐতিহাসিক বলেন, লালগোলা রাজবাড়িতে থাকাকালীন বঙ্কিমচন্দ্র কালীবাড়িতে ঢুকে ডান দিকের দোতলার একটি ছোট ঘরে বসে লেখালিখি করতেন। বর্তমানে ওই ঘরের ভেতরের অংশ ভেঙে পড়েছে। সিঁড়িও ভেঙে পড়েছে।
১৮৬৮ সালে রাজবাড়ির তরফ থেকে যে অতিথি নিবাস তৈরি করা হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র সেখানেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। পরবর্তীকালে সেটি লালগোলার বিডিও অফিস ছিল। তবে সংস্কারের অভাবে সেই ভবন এখন জীর্ণ।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তরফ থেকে দু'বার 'সার্ভে' করা হলেও ভবন সংস্কারের জন্য কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অনেকের অভিযোগ।
লালগোলার সাধারণ মানুষ দাবি করেন, যে প্রেক্ষাপটে বসে এই বিখ্যাত কালজয়ী গান রচনা করা হয়েছিল তার প্রায় সবই মুছে যেতে বসেছে।
লালগোলাবাসীর অভিযোগ, যেখানে বসে এই গান রচনা করা হয়েছিল আজ পর্যন্ত সেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের একটি মূর্তিও নেই। কেবল রাজবাড়ির দেওয়ালে সাহিত্য সম্রাটের একটি ছবি আঁকা রয়েছে। যেখানে প্রদীপ-মোমবাতি জ্বালিয়ে সম্মান জানান তাঁর গুনগ্রাহীরা।
মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক অরিন্দম রায় বলেন, 'বন্দে মাতরমের সুতিকাগার রক্ষা করার জন্য এখনও তেমন কোনও উদ্যোগ আমার চোখে পড়েনি। বন্দে মাতরমের ১৫০ বছর দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে। কিন্তু যে প্রেক্ষাপটে এবং যেখানে বসে এই গান রচনা করা হয়েছিল সেখানে কোনও স্মারক চিহ্ন তৈরি করা হয়নি বা সেই এলাকাকে প্রচারের আলোয় আনার জন্য কোনও ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।'
তিনি জানান, 'বঙ্কিমচন্দ্র লালগোলায় থাকার কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও রয়ে গিয়েছে। সেগুলো নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করা যেতে পারত। লালগোলায় যেখানে বসে বঙ্কিমচন্দ্র এই গান রচনা করেছিলেন সেখানে তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা হলে সাধারণ মানুষ ওই ঐতিহাসিক জায়গার গুরুত্ব বুঝতে পারবেন।'
এই বিষয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, 'বিজেপি এখন বন্দে মাতরম নিয়ে মাতামাতি করছে বা বোঝাতে চাইছে তারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সংগ্রামীদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল! অথচ এদের পূর্বসূরিরা সেইসময় এই সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তো দূরের কথা বরং উল্টে ব্রিটিশদের দালালি করত। আর যদি এই গানের সুতিকাগার সংরক্ষণের প্রশ্ন ওঠে তবে আমি বলব এই বিষয়টি আমাদের মধ্যে খুবই অভাব। 'হেরিটেজ' রক্ষায় আমরা উদাসীন। যার প্রমাণ কলকাতায় মধুসূদন দত্তর বাড়ি বা দীনবন্ধু মিত্রর বাড়ি!'
