আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্ব ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনা যেমন তাঁর শরীরে চিরস্থায়ীভাবে খোদাই করেছিলেন চে গেভারার মুখ— সেই আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া মার্কসবাদী বিপ্লবী, যিনি ফিদেল কাস্ত্রোর সহযোদ্ধা হিসেবে কিউবার বিপ্লবে ইতিহাস গড়েছিলেন— তেমনই এখন বাংলার রাজনীতিতেও দেখা যাচ্ছে নেতাবন্দনায় ট্যাটুর নয়া ধারা। একসময় বাম রাজনীতির অনেক কর্মীর হাতে চে-র মুখের উল্কি ছিল, কিন্তু জীবিত রাজনীতিকদের মুখ ট্যাটু করানোর প্রবণতা— এ একেবারে নতুন পর্ব।

মেটিয়াবুরুজের তৃণমূল কর্মী প্রীতম পান্ডে সেই নতুন পর্বেরই প্রতিনিধি। বছর তিরিশের এই তরুণ তাঁর ডান হাতে ট্যাটু করিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ। বিজয়া সম্মিলনীতে উপস্থিত হয়ে নিজের সেই ট্যাটু ‘ক্যাপ্টেন’ অভিষেককে দেখাতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হন তিনি। প্রীতমের মুখে মিশ্র আবেগ— “আমি প্রথম ভোট দিয়েছিলাম অভিষেকদাকে। বাবা-মা নেই, অভিষেকদাই আমার সব।” প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা সেই ট্যাটুর খরচ পড়েছিল পাঁচ হাজার টাকার মতো।

অন্যদিকে, হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা, সিপিএম কর্মী সুজিত বসু নিজের বাম বুকে ট্যাটু করিয়েছেন যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের মুখাবয়ব। লালঝান্ডা হাতে মঞ্চের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তাঁর ট্যাটুই হয়ে ওঠে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। “মিনাক্ষীকে অন্যরকম নেতা মনে হয়। ক্যাপ্টেন,” বলেন পেশায় কেটারিং ব্যবসায়ী সুজিত, যার গোটা পরিবারই বামপন্থী। তাঁর উল্কি করতে লেগেছিল চার ঘণ্টা, খরচ হয়েছিল সাড়ে চার হাজার টাকা।

আরও পড়ুন: ডাক্তারি পড়ুয়াদের জন্য খুশির খবর, দেশজুড়ে মেডিকেল কলেজগুলিতে বাড়তে চলেছে কয়েক হাজার আসন!

দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে এই প্রবণতা বহু আগেই দেখা গিয়েছিল। জয়ললিতার জন্মদিনে তাঁর হাজারেরও বেশি ভক্ত হাতে খোদাই করিয়েছিলেন ‘আম্মা’র মুখ। কর্নাটকের এক তরুণ নিজের পিঠজুড়ে মোদির  মুখ আঁকিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে ২৫ জন যুবক যোগী আদিত্যনাথের মুখের ট্যাটু করান ২০২২ সালের ভোটের আগে। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে নেতার প্রতি আবেগ অনেক সময় ধর্মীয় ভক্তির সীমা ছুঁয়েছে, আর এখন তার ছোঁয়া পৌঁছে গিয়েছে বাংলার রাজনীতিতেও।

ট্যাটুর ইতিহাস কিন্তু প্রাচীন। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য বলছে, সাত হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও মানুষ শরীরে উল্কি আঁকত। মিশরীয় ও মায়া সভ্যতার নিদর্শনেও ট্যাটুর প্রমাণ মেলে। আজও ক্রীড়া ও বিনোদনের জগতে ট্যাটু পরিচয়ের ভাষা। মেসির পা, মারাদোনার বাহু, বিরাট কোহলি বা হার্দিক পান্ডিয়াদের দেহে ট্যাটুর ছাপ— সবই আত্মপ্রকাশের প্রতীক।

তবু, বাংলার রাজনীতিতে এর আগমন এক নতুন মানসিকতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখনকার তরুণ কর্মীরা নেতা বা নেত্রীকে শুধু রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের এক আত্মিক বন্ধনে দেখছেন। এক প্রজন্ম যারা দেব-দেবীর মূর্তি বা চলচ্চিত্র নায়কের মুখে নয়, বরং রাজনীতির তরুণ মুখে খুঁজে পাচ্ছে নিজেদের আশ্রয়।

অবশ্য, সকলেই এ প্রবণতাকে একইভাবে দেখছেন না। কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী ঋজু ঘোষাল, যিনি নিজেও ট্যাটুবিলাসী, মনে করেন ট্যাটু ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রতিফলন। “আমি ট্যাটু দেখি আত্ম অনুভূতির জায়গা থেকে,” বলেন তিনি। “যাঁরা নেতা-নেত্রীর মুখ ট্যাটু করান, তাঁদের ক্ষেত্রেও সেটা হয়তো ভালোবাসা বা অনুপ্রেরণার প্রকাশ।”

কিন্তু তবু এক পার্থক্য থেকে যায়। দীপিকা পাড়ুকোন ঘাড়ে রণবীরের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করেছিলেন, পরে প্রেম ভেঙে গিয়েছে, ট্যাটুও তুলেছেন। কিন্তু মেটিয়াবুরুজের প্রীতম বা হুগলির সুজিতের ভালোবাসা অন্যরকম— এ প্রেমে বিভাজন নেই, ভাঙন নেই। নেতার মুখ খোদাই হয়ে রইল ত্বকের নিচে, হয়তো চিরকালের জন্য।

বাংলার রাজনীতিতে এই ট্যাটু-প্রেম এক নতুন সংস্কৃতির সূচনা করেছে— যেখানে রাজনীতি আর ব্যক্তিসত্তা একসূত্রে বাঁধা, নেতা হয়ে উঠছেন ভক্তের শরীরেরই এক অংশ। ইতিহাস বলবে, এ শুধু শরীরে উল্কি নয়, সময়ের শরীরে এক নতুন ছাপ।