আজকাল ওয়েবডেস্ক: 'বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ'— তারই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ কালীপুজো। দুর্গাপুজো ও লক্ষ্মীপুজোর পর বাঙালি মেতে ওঠে শক্তির আরাধনায়। আবহমান কাল ধরে এই রীতিই চলে আসছে। শহর থেকে গ্রাম, সর্বত্রই চলে আসছে এই প্রথা। শক্তির এই আরাধনায় জায়গা ভেদে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে যা বয়ে নিয়ে চলেছেন সেখানকার বাসিন্দারা।‌ 

 

যেমন নদীয়ার শান্তিপুর। এই শহরের আনাচে-কানাচে রয়েছে বহু অজানা ইতিহাস। দুর্গাপুজো, রাস বা অন্যান্য উৎসবের পাশাপাশি শক্তি আরাধনায় রয়েছে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের কাহিনী। নদীয়ার শান্তিপুর শহরের বহু প্রাচীন পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম হল আগমেশ্বরী কালীপুজো। যার সূচনা হয়েছিল আনুমানিক প্রায় ৪০০ বছর আগে।

 

এই পুজোর ঐতিহ্যে জড়িয়ে আছে তন্ত্রসাধক ও পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীস-এর নামের সঙ্গে। ১৬ শতকের প্রথমার্ধে, শ্রীচৈতন্যদেবের পরবর্তী সময়ে, তিনি তন্ত্রসাধনায় এক নতুন ধারা সূচনা করেন। তিনিই দক্ষিণা কালীপুজোর প্রচলন করেন বলে অনেকের বিশ্বাস। তাঁর পৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীস শান্তিপুরে এই আগমেশ্বরী পুজোর সূচনা করেন। তন্ত্র ও আগমশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য তাঁরা 'আগমবাগীস' উপাধি লাভ করেন। সেই সময় শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও, শান্তিপুরে এক আধ্যাত্মিক মিলনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন সার্বভৌম আগমবাগীস। তিনি নবদ্বীপের অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র মথুরেস গোস্বামীর কন্যাকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের নিয়ে শান্তিপুরে এসে এক পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপনা করে তন্ত্র সাধনায় মন দেন।

 

এক বিশেষ দিনে সাধনারত কৃষ্ণানন্দ গঙ্গার ঘাটে গিয়ে দর্শন পান এক গোপবধূর। তাঁর কালো রঙের মধ্যেও অপরূপ সৌন্দর্য ছিল। লোকে বলে সেই গোপবধূকে ঈশ্বররূপে অনুভব করেন কৃষ্ণানন্দ। সেই স্থানেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেন এবং গঙ্গার মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণ করে শুরু হয় আগমেশ্বরী কালীপুজো। তাঁর স্মরণে আজও এই জায়গা 'আগমেশ্বরী তলা' নামে পরিচিত।

 

এই পুজোর দায়িত্ব আজও বড় গোস্বামী পরিবার বহন করে আসছে। পুজোর সূচনা হয় বিজয়া দশমীর দিন সিঁদুর দান ও খিলান পাঠ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। কালীপুজোর দিন মৃন্ময়ী প্রতিমায় রঙ করা হয়। রাত ন'টায় দেবীকে গহনা পরিয়ে সাজানো হয় এবং রাত এগারোটায় চক্ষুদান করে পুজোর সূচনা হয়। পুজো চলে ভোররাত পর্যন্ত। সম্পূর্ণ তান্ত্রিক রীতিতে ও নিষ্ঠার সঙ্গে। এখানে পশুবলি হয় না। বলি হয় দুটি আঁখ ও একটি চাল কুমড়ো। গোস্বামী পরিবারের দীক্ষিত মহিলারা রান্না করেন ৩৬ রকমের নিরামিষ ভোগ। যার মধ্যে থাকে শাক, ডাল, তরকারি, পোলাও, চাটনি, মিষ্টি ও ফল।

 

পুজোর পরদিন প্রতিমার বিসর্জন হয় শান্তিপুরের মতিগঞ্জ ঘাটে। আগে কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে যাওয়া হত। বর্তমানে সেই প্রথা আর চালু নেই। এই আগমেশ্বরী কালীপুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। বরং এটি শান্তিপুরের এক আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী উত্তরাধিকার। যেখানে মিলেছে তন্ত্র, সাধনা, ভক্তি ও ঐতিহ্য। এখানকার বাতাস ফিসফিস করে সেই কথাই বলে।