মিল্টন সেন, হুগলি: সিঙ্গুরের কৃষকরা কখনওই শিল্পের বিরোধিতা করেননি। তাঁরা জোর করে জমি ছিনিয়ে নেওয়ার যে পদ্ধতি, তার প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁরা আজও মনে করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্প স্থাপনের চেষ্টায় কোনও ভুল ছিলনা। ভুল ছিল জমি অধিগ্রহনে পদ্ধতিতে। যার ফলে শিল্প এবং কৃষি দুটি ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে সিঙ্গুর। এমনটাই মনে করছেন সিঙ্গুরের বাসিন্দারা।
তাছাড়া তাঁরা এটাও মনে করেন, ওই ভুলের জন্য সিঙ্গুর থেকে ন্যানো বিদায় সিঙ্গুর তথা সমগ্র বাংলায় শিল্প সম্ভাবনার ক্ষতি করেছে। সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা হবে এই সূচনা মিলেছিল ২০০৬ সালে। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন সিঙ্গুরে টাটাদের ছোট গাড়ির কারখানা হবে। সেই অনুযায়ী শুরু হয়েছিল জমি অধিগ্রহণ। মোট ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই জমি অধিগ্রহনের পদ্ধতিতেই ভুল ছিল, আজও মনে করেন সিঙ্গুরের বাসিন্দারা।
তাঁদের বক্তব্য, অনিচ্ছুক কৃষকদের প্রতি সরকারের নরম মনোভাব দেখানো দরকার ছিল। ক্ষতিপূরণ নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। এখনও এমনটাই মনে করেন সিঙ্গুরের অধিকাংশ কৃষক। তবে সে সময় শিল্পের জন্য অনেকেই স্বইচ্ছায় তাঁদের জমি দিয়েছিলেন। তাদের মতে শিল্প হলে সিঙ্গুরের উন্নয়ন হত। সার্বিকভাবে বেকারদের কাজের সুযোগ তৈরি হতো, সেই কথা ভেবেই তারা জমি দিয়েছিলেন। দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হাইওয়ের পাশের জমিতে চাষ হত। তাই অনিচ্ছুক চাষিরা এই জমি দিতে চাননি।
টাটা শিল্প গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা প্রথম দিন সিঙ্গুরে জমি পরিদর্শনে এসে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। সেদিন থেকেই হয় কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত। এরপরই ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। রাজ্য সরকার পুলিশ দিয়ে সেই আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে। সেই চেষ্টায় কার্যত হিতে বিপরীত হয়। একদিকে শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি আন্দোলনের সুরও ক্রমশ চড়তে থাকে। টাটাদের তরফে শুরু হয় জমিদাতা পরিবারের বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ। কারখানা তৈরির কাজ প্রায় শেষের মুখে এমন সময় কৃষক আন্দোলন আরও জোরদার হয় ওঠে।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শুরু হয় ধর্না। টানা ১৮ দিন ধরে লাগাতার সেই ধর্না চলাকালীন সিঙ্গুর ছাড়েন রতন টাটা। সেই খবরে তখন আশাহত হয়েছিলেন অনেকেই। তাই সিঙ্গুরে টাটাদের ছোটো গাড়ির কারখানা হয়নি। তবু ৯৯৭ একর জমির নাম হয়ে গেছে টাটার মাঠ। ওখানে গড়ে উঠতেই পারত আরেকটা টাটা নগর। রতন টাটাও বলেছিলেন মাথায় বন্দুক ঠেকালেও সিঙ্গুর ছাড়ব না। কিন্তু অবশেষে অনিচ্ছুক কৃষকদের লাগাতার আন্দোলনে সিঙ্গুর ছাড়তে বাধ্য হয় টাটা কম্পানি।
পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জমি ফিরে পেয়েছেন কৃষকরা। তবে অনেক জমি এখনও অনাবাদি, চাষ হয়না। সিঙ্গুরে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলন।
সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের জোরা আন্দোলনের দাপটে ২০১১ সালে পতন হয় তৎকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের। তবে সিঙ্গুরে শিল্পের প্রসঙ্গ উটলেই উঠে আসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম। সেই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে ১৮ বছর। আজও সিঙ্গুরের কৃষকদের মধ্যে ইচ্ছুক অনিচ্ছুক ভাগ বহাল রয়েছে। আজও স্বইচ্ছায় জমি দাতারা মনে করেন শিল্প হলে পাল্টে যেত সিঙ্গুর। তবে আজও অনিচ্ছুকরা মনে করেন, অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিলো। আলোচনা করলে বিষয়টা মিটে যেত। তাঁদের সেই আন্দোলন কখনোই সিঙ্গুরে শিল্প স্থাপনের বিরুদ্ধে ছিলেননা। তাঁরা তখন আন্দোলন করেছিলেন জোর করে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে।
