আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা সরাসরি ভারত শাসনের অধিকার দখল করে। এরপর ১৭৬৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটেন, ভারত থেকে ৬৪.৮২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থমূল্যের সম্পদ শোষণ করেছে। আর এই সম্পদের মধ্যে ৩৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার ভোগ-দখল করেছেন ব্রিটেনের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী জনগণ। এই অর্থের পরিমাণ এতই বিপুল যে, ৫০ পাউন্ড মূল্যের নোট দিয়ে লন্ডন শহরকে প্রায় চারবার মুড়ে দেওয়া সম্ভব। আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থা অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক বৈঠকের প্রথম দিনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এই প্রতিবেদনের শিরোনাম 'টেকার্স, নট মেকার্স' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। 

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আধুনিক বহুজাতিক সংস্থার ধারনা মূলত উপনিবেশবাদের সৃষ্টি। উপনিবেশবাদের সময় তৈরি হওয়া বৈষম্য এবং লুটপাটের প্রবণতা এখনও আধুনিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। অক্সফাম বলেছে, "উপনিবেশবাদ থেকে শুরু হওয়া এই বৈষম্য একটি গভীর অসম পৃথিবী তৈরি করেছে। এটা এমন এক বিভক্ত পৃথিবী তৈরি করেছে যেখানে বর্ণবৈষম্য বিদ্যমান এবং দক্ষিণ গোলার্ধের সম্পদ উত্তর গোলার্ধের ধনীরা নিয়মিত শোষণ করছে।"

বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে অক্সফাম দেখিয়েছে যে, ১৭৬৫ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে ব্রিটেনের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী ভারত থেকে ৩৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার শোষণ করেছে। এই অর্থ যদি ৫০ পাউন্ডের নোটে রূপান্তর করা হয়, তবে তা দিয়ে সমগ্র লন্ডন শহরকে চারবার ঢেকে দেওয়া সম্ভব। এতে আরও বলা হয়েছে যে, বর্তমান ব্রিটেনের অনেক ধনী পরিবারের সম্পদের উৎস প্রধানত দাস-প্রথা এবং উপনিবেশবাদে নিহিত। 

আধুনিক বহুজাতিক সংস্থাগুলিও উপনিবেশবাদের ফসল। যেমন, ভারতে কাজ করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেকে একটি স্বতন্ত্র আইনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল এবং বহু ঔপনিবেশিক অপরাধের জন্য দায়ী ছিল। আজকের দিনে এই সংস্থাগুলির মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিও প্রায় একচেটিয়া অবস্থান নিয়ে দক্ষিণ গোলার্ধের শ্রমিকদের শোষণ করে, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের। আর এর থেকে লাভবান হন প্রধানত উত্তর গোলার্ধের ধনী অংশীদাররা।

এশিয় বস্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর সুরক্ষাবাদী নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারতের শিল্প উৎপাদন ধ্বংস করার জন্য ঔপনিবেশিকতাবাদকে দায়ী করেছে গ্রুপটি। বলা হয়েছে, "১৭৫০ সালে, বিশ্বব্যাপী শিল্প উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ হত ভারতীয় উপমহাদেশ। তবে, ১৯০০ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটি হঠাৎ করে মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছিল।"

অক্সফাম বলেছে, "বেশির ভাগ উপনিবেশবাদ পরিচালিত হয়েছে বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে। এসব সংস্থার অনেকে একচেটিয়া সুবিধা পেয়েছিল এবং উপনিবেশ বিস্তারে বিপুল সাফল্য লাভ করেছিল।" প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে ছিল, ২ লাখ ৬০ হাজার সৈন্য। এই সংখ্যা যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চেয়েও বহরে বড় ছিল। 

অক্সফামের দাবি, ডাচ এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলি ছিল মাদক দ্রব্যের বাহক, যারা উপনিবেশের উপর তাদের শাসন সুসংহত করার জন্য আফিম ব্যবসা চালু করেছিল। পূর্ব ভারতের উর্বর জমিতে বেশি করে আফিম চাষ হত, চিনে রপ্তানি করা হত। 

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, "১৮৭৫ সালে ভারতে সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী ব্যক্তিরা মূলত ব্রিটিশ সেনা ও প্রশাসনের ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ছিলেন। কিন্তু ১৯৪০ সালে তাদের জায়গা নেন ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার এবং শিল্পপতিরা। ঔপনিবেশিক দেশগুলির হাত থেকে স্বাধীনতা হওয়ার পরও বিশ্বের অনেক দেশের গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলে ধন-সম্পদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কেবল ধনী ব্যক্তিদের হাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। অক্সফাম বলেছে, "এই দেশগুলোতে যে বৈষম্য আজ দেখা যায়, তা অনেকাংশেই ঔপনিবেশিক যুগের ফল।"