সম্পূর্ণা চক্রবর্তী: কলকাতা ছেড়ে গুরগাঁওয়ে চলে যাওয়ার আগে শেষ দেখা। মাস দুয়েক আগের কথা। তবে শুধু চোখের দেখা। কথা হয়নি। সেই অবস্থায় ছিলেন না ভেস পেজ। দীর্ঘ সাত-আট মাস ধরেই গুরুতর অসুস্থ। ঠিক মতো কথা বলতে পারতেন না। হাত নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তাই সই। দীর্ঘদিনের শহর ছাড়ার আগে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ভোলেননি গুরবক্স সিং। বৃহস্পতিবার সকালে গুরগাঁও থেকে ফোনে এই কথাগুলো বলতে বলতে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ৬০ বছরের পার্টনারশিপের ইতি। যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না এখনও। বৃহস্পতিবার রাত তিনটেয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বন্ধু। গুরবক্স সিংয়ের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন এই ঘটনার পর ঘন্টা সাতেক কেটেছে। কিন্তু ঘোর কাটেনি তাঁর। আগের দিন রাতে ভেস পেজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। জেনেছিলেন, ক্রমাগত অবস্থার অবনতি ঘটছে। কিন্তু হকির 'জয়-বীরু' জুটি যে ভাঙতে চলেছে, সেটা নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারেননি। প্রার্থনা করছিলেন, যেন এই যাত্রায় বেঁচে যায় বন্ধু। কিন্তু সকালে লিয়েন্ডারের ফোন পেতেই সব শেষ। 

গুরবক্স সিং বলেন, 'কাল ওর স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়। জানায় অবস্থা খারাপ। আগের দিন থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। আমি গুরগাঁও আসার আগে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম। আগের বছর ডিসেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। গত দু'দিন ওর স্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবার বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়। গতকাল রাতে আবার হাসপাতালে নিয়ে যায়। কথা বলতে পারছিল না। শুধু হাত নাড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। গত ছয়-সাত মাস ধরে অবস্থা খারাপ ছিল। তিন-চার মাস আগে আমার সঙ্গে শেষবার ভাল মতো কথা হয়েছে। আজ সকালে লিয়েন্ডারের সঙ্গে কথা হল। খুব ভেঙে পড়েছে। ও ছিল মৃত্যুর সময়।'

স্মৃতির সরণি বেয়ে ছয়ের দশকে ফিরে যান গুরবক্স সিং। প্রথম আলাপ, তারপর একসঙ্গে খেলা, ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়া। সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যেন সেদিনের কথা। মাঝে ৬০ বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু গুরবক্স সিংয়ের স্মৃতিতে এখনও টাটকা। ঠিক কোন সালে সদ্য প্রয়াত বন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা, ভোলেননি। তবে স্মৃতির পাহাড়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও ঘটনার উল্লেখ করতে চাননি। গুরবক্স সিং বলেন, 'ও যখন কলেজে পড়ত তখন আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ। সালটা ১৯৬৬। আমি ভারতের অধিনায়ক ছিলাম। আমার সঙ্গে ভারতীয় দলে ঢুকল। তখন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ে। সেই প্রথম দেখা। আমরা ১৩ বছর একসঙ্গে মোহনবাগানে খেলেছি। ৩০ বছর এক দলে খেলেছি। এমএমসি, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, সিসিইএফসি। মোট ৩৬ বছর একসঙ্গে খেলেছি। ৬০ বছরের বন্ধুত্ব। ভাল ডাক্তার ছিল। সর্বোপরি ভাল মানুষ ছিল। স্পোর্টস মেডিসিনের অগ্রদূত ছিল। কত অলিম্পিকে গিয়েছে লিয়েন্ডারের সঙ্গে। ওর সঙ্গে আমার এত স্মৃতি, আলাদা করে কিছু বাছা যাবে না। অসাধারণ প্লেয়ার ছিল। ভাল সুযোগ পেলে আরও ওপরে যেতে পারত। ভারতীয় হকির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।' তাঁর নিজেরই ৮৯ বছর বয়স। ভেবেছিলেন ভেস পেজের সঙ্গে পার্টনারশিপ আরও কিছু বছর চলবে। বন্ধুহারা হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তবে স্মৃতি আঁকড়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান গুরবক্স সিং।